কোভিড-১৯ মহামারীঃ চীন — খোলসের আড়ালের বাস্তবতা

[সম্পাদকীয় নোটঃএই নিবন্ধটি ইংরেজী তে রেডস্পার্ক ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছিলো। চীনের অভ্যন্তরীণ একজন এর বক্তব্য বিবেচনায় নিয়ে বিপ্লবী ছাত্র-যুব আন্দোলনের পক্ষ থেকে আমরা ইংরেজী নিবন্ধটির বাংলায় অনুবাদ করে প্রকাশ করছি।যদিও এই প্রবন্ধের বেশ কয়েকটি বিষয়ের সাথে একমত নই।চীন রাষ্ট্র সম্পর্কের লেখকের সাথে আমরা একমত নই।তাই পাঠককে অনুরোধ করবো বক্তব্যটিকে দ্বান্দিকভাবে দেখবার।এই প্রবন্ধে ভাইরাস এবং পুঁজি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছে। প্রবন্ধটি অনুবাদ করেছেন তরুন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী কমরেড আতিক চৌধুরী।]

ব্যাপকভাবে দমনের কারণে চীনা মালেমাবাদী কমরেডদের মতামত ও দৃষ্টিভঙ্গি জানতে পারা প্রায়ই অসম্ভব হয়ে দাড়ায়। কিন্তু আজ আমরা ভাগ্যবান — চীনে কোভিড-১৯ মহামারী পরিস্থিতির উপর, একজন প্রবীণ মালেমাবাদী ঘরানার কমরেডের পাঠানো নিম্নোক্ত আর্টিকেলটি আমরা প্রকাশ করতে পারছি।

একটি ভূত দুনিয়াকে তাড়া করছে — কোভিড-১৯ এর ভূত।

এটা কোন জাতীয় সীমানা বা বর্ণগত বিভেদ মানে না — এটা চীনের অধিবাসীদের আক্রান্ত করে, তাদেরকে সহ যারা নিজেদের মনে করে অসীম ক্ষমতাধর। এটা মানবসমাজের ঔদ্ধত্য আর শ্রেনীবিভাগের(hierarchy ) তোয়াক্কা করে না।

এটা ঠিক কীভাবে ‘প্যান্ডরার বাক্স’ থেকে বের হলো সেটা অমীমাংসিতই রয়ে গেছে। বিজ্ঞান আর রাজনীতি, ভুক্তভোগী আর বলির পাঁঠা, সব এখন একসাথে মিশে জট পাকিয়ে গেছে।

ভাইরাসটি মানবজাতির সাধারণ শত্রু এবং মানবজাতি এটাকে একত্রে পরাজিত করবে। শ্রেণী-অন্ধ ও জাতি-অন্ধ হয়েও ভাইরাসটি শ্রেনীসমাজের কিছু দ্বন্দ্ব উন্মোচন করে দিয়েছে। মানুষের ঔদ্ধত্য ও কুসংস্কারাচ্ছন্নতা, এবং শাসকশ্রেণীর মূর্খতা ও স্বল্পদর্শীতা এখন অনেক পরিষ্কার।

১। রাজনৈতিকবৃন্দ, ভাইরাস এবং জনগণঃ

‘করোনা’ নামটি ভাইরাসের মুকুট-সদৃশ আকৃতি থেকে এসেছে। চীনা ভাষায় ‘মুকুট’ আর ‘আমলা’ শব্দের উচ্চারণ একই রকম(গুয়ান)। তাই চীনে মানুষ এটাকে আমলা-ভাইরাস বলেও ডাকে। ‘করোনা’ শব্দটি আকৃতির দিকে নির্দেশ করে, অন্যটি বুঝায় এটার প্রকৃতিকে।

চীনের উহানে এটি প্রথম আক্রমণ করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এটার নাম দেয় কোভিড-১৯(করোনা ভাইরাস ডিজিস ২০১৯), যেহেতু এটি ২০১৯এ আবিষ্কৃত হয়। প্রথমে সার্স বলে মনে করা ভাইরাসটি প্রথম প্রকাশ্যে আসে ৩০ ডিসেম্বর ২০১৯ এ, নতুন বছরের একটু আগে।

সেই দিন, উহান কেন্দ্রীয় হাসপাতালের ইমারজেন্সি রুমের একজন ডাক্তার আই ফেন, একটি ‘অজ্ঞাত’ নিউমোনিয়া সম্পর্কিত টেস্ট রিপোর্ট হাতে পান। তিনি রিপোর্টে ‘সার্সে’র চিহ্ন দেখেন এবং সার্স সম্পর্কে চীনা মানুষের, বিশেষত ডাক্তারদের অতিরিক্ত সতর্কতা থাকায়, তিনি রিপোর্টের ছবি তুলে উইচ্যাটে সহকর্মীদের কাছে পাঠিয়ে দেন। সেই রাতে রিপোর্টটি দ্রুত উহানের ডাক্তারদের কাছে ছড়িয়ে যায়। ৮ জন ডাক্তার যারা তথ্যটি প্রকাশ করে, তারা পরে “গুজব ছড়ানোর” দায়ে পুলিশের হয়রানির স্বীকার হন।

আসলে এর ৪ দিন আগে, ২৭ ডিসেম্বরে ‘হুবেই সমন্বিত চিরাচরিত ও পশ্চিমা হাসপাতালে’র ড. জ্যাং জিশিয়ান আগেই উহান প্রশাসনের কাছে ৪ টি সন্দেহজনক নজির রিপোর্ট করেন। ২৯ তারিখে উহান শহর এবং হুবেই প্রদেশের স্বাস্থ্য বিভাগ একটি এপিডেমিওলজিকাল তদন্ত শুরু করে।

ডাক্তাররা হচ্ছেন স্বাথ্যের প্রহরী, অনেকটা রক্ষাকর্তার মত—প্রায়ই শত্রুকে প্রথম চিহ্নিত করে থাকেন। ড. জ্যাং জিশিয়ান যখন পরে তার কাজের জন্য আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেলেন, অন্য ৮ জন ডাক্তারকে —’হুইসেল ব্লোয়ার’ও বলা হয় যাদের —তথ্য প্রকাশের জন্য শাস্তি পেতে হলো। বিশেষত ড. লি ওয়েনলিয়াংকে উহানের স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা ও হাসপাতাল একাধিকবার শাসায়। তাকে নিজের ‘ভুল বুঝতে’ বাধ্য করা হয়, এবং আত্মসমালোচনামূলক প্রবন্ধ লেখানো হয়। দুঃখজনকভাবে, পরে তিনি মাত্র ৩৪ বছর বয়সে মারা যান, সেই ভাইরাসের কারণেই যেটিকে তিনি অস্বীকার করুক — এটিই ছিল সরকারের চাওয়া। তিনিই প্রথম নিগৃহীত এবং প্রথম রক্ষাকর্তা যিনি এই যুদ্ধে মারা যান। কেন ড. জ্যাং এবং ড. লি পুরাপুরি আলাদা আচরণের স্বীকার হলেন?

রক্ষাকর্তারা কমান্ডার নন। ঘণ্টা বাজানো হবে কিনা, বা সৈন্য সমাবেশ করা হবে কিনা, তা নির্ভর করে সমাজের নিয়ম আর প্রথার উপর। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে যদিও সহজেই সরকারি স্বাস্থ্য বিভাগগুলো থেকে তথ্য ছড়িয়ে পরতে পারে। যদি দেখা যায় তথ্যটি ভুল ও ক্ষতিকর, তাহলে এটা সাথেসাথে বিশাল গুজবে পরিণত হয়ে, চীনের মত স্বচ্ছতার অভাববিশিষ্ট সমাজে গণ আতঙ্কে পরিণত হতে পারে। কোন রাষ্ট্রযন্ত্রই এটা সহ্য করবে না।

এই দৃষ্টিকোণ থেকে, ৮ জন ডাক্তারের হয়রানি অহেতুক না। এই আচরণের অর্থ বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ নাও হতে পারে। ছোট একটা দোষ শুধরাতে গিয়ে সরকার বড় ভুল— আসলে বিশাল অপরাধ করে ফেলল!

৩০ ডিসেম্বরে ৮ জন ডাক্তার প্রথম খবরটি প্রকাশ করে। উহান স্বাস্থ্য বিভাগ সেই নিউমোনিয়ার উপরে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে, যাতে ‘মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণ’ ও ‘সংক্রমিত স্বাস্থ্যকর্মী’দের ব্যাপারটি অস্বীকার করা হয় এবং ৮ জন ডাক্তারকে শাসানো হয়। ২ জানুয়ারি ২০২০ এ, শিনহুয়া বার্তাসংস্থা ও চীনা কেন্দ্রীয় টেলিভিশনসহ অন্যান্য মূলধারার মিডিয়া “৮ জন গুজব রটনাকারীর আইনি শাস্তির” খবর প্রচার করলো — কার্যত সবাইকে জানানো হল,সবকিছু স্বাভাবিক এবং নিরাপদ।

এর মধ্যে রাজনৈতিক ও আমলারা সবরকম নাটক আর প্রহসনই দেখাল। যেমন, স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে মাস্ক ও পিপিই ব্যবহার কমানো এবং গণ জমায়েত হতে দেওয়া। এমনকি স্থানীয় সরকার মানুষকে শান্ত করার জন্য নতুন বছরের অনুষ্ঠানও আয়োজন করলো। যেন প্রায় দেখাই যাচ্ছিল যে তারা নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে প্রকৃত তোয়াক্কাই করে না, বরং জনগণের দৈনন্দিন জীবন সম্পর্কে উদ্বিগ্ন। এরকম চলতে থাকলো ২০ জানুয়ারির আগ পর্যন্ত, যতক্ষণ না জাতীর স্বাস্থ্য বিভাগের বিশেষজ্ঞ টিমের একজন নেতা জং নানশাং, মানুষ থেকে মানুষে ছড়ানোর কথা প্রকাশ্যে নিশ্চিত করলেন। এটা প্রথম নোটিসের তিন সপ্তাহ পরের ঘটনা, যখন এটি ইতিমধ্যেই চরমভাবে ছড়িয়ে পরেছে। এর ঠিক ৩ দিন পরে, ২৩ জানুয়ারিতে উহানকে জোর করে লকডাউন করা হলো।

এই কারণেই চীনের মানুষ বলে, “৮ জন মানুষকে চুপ করানো হলো, তারপর সমস্ত চীনে তালা মারা হলো।” আপাতদৃষ্টিতে, যুক্তি হলো এই যে, বাকস্বাধীনতার অভাব এই দুর্যোগ ডেকে আনল। কিন্তু আসল সমস্যা এটি নয়। এইরকম মিথ্যা বলা, খবর চাপা দেওয়া, মিথ্যা খবর ছড়ানো, বাকস্বাধীনতা থাকতেও পশ্চিমেও খুবই স্বাভাবিক। যেমন, মার্কিন রাষ্ট্রপতি অনেক আরামে আজেবাজে কথা বলতে পারে, কিন্তু এতে জনগণের দুর্ভোগ একটুও কমে না।

কে আমাদের মিত্র আর কে শত্রু? স্বভাবত, এটা যথেষ্ট পরিষ্কার যখন আমরা সরকার, শ্রমিক জনগণ এবং একটি মারাত্মক ভাইরাস নিয়ে কথা বলছি। দুঃখজনকভাবে, মহামারীতে অনেক মানুষ ভাইরাস আর সরকারের সমস্যাগুলোকে গুলিয়ে ফেলেছেন।

মাওবাদী সময়কালে চীনের রোগব্যাধি ও স্বাস্থ্য-হুমকি মোকাবেলার অনেক সফল অভিজ্ঞতা ছিল, যেমন, সিস্টোসোমাইসিস(স্নেইল ফেভার) ও ম্যালেরিয়া। এটা সম্ভব হয়েছিল কমিউনিস্ট পার্টি, বিজ্ঞানী ও জনগণের প্রচণ্ডরকমের সমন্বিত কার্যক্রমের কারণে। এই গুরুত্বপূর্ণ ধারাটি চীনে ছিল।

২০০৩ সালে, সার্সের তীব্রে প্রাদুর্ভাব দেখা যায়, যা চীনের জনগণের মনে গভীর ছাপ ফেলে এবং এধরণের ভাইরাসকে গুরুত্ব দিতে শিখায়।

২০০৩ এর পরে চীন ১০ কোটি ডলারের বেশি খরচ করে বিশ্বের বৃহত্তম সংক্রামক রোগ ও জনস্বাস্থ্য রিপোর্টিং সিস্টেম বানায়। এই সিস্টেম ২ ঘণ্টারও কম সময়ে জনস্বাস্থ্যের তথ্য কেন্দ্রীয় সরকারকে অবগত করতে পারে, যা দ্রুত প্রমাণ-নির্ভর সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়। কিন্তু কথা হলো, ২০১৯ এ এক শীর্ষ চীনা সিডিসি(রোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র) কর্মকর্তা নিঃসংকোচে জানান যে চীনে সার্স-ট্র্যাজেডির পুনরাবৃত্তি হবে না।

জনস্বাস্থ্যের সুদক্ষ সফলতার ইতিহাস, জন-নির্ভর পৃষ্ঠপোষকতামূলক প্রতিরোধ ব্যবস্থা, এর সাথে উন্নত যোগাযোগ প্রযুক্তি — তবুও আমাদের আজকের এই অবস্থা। এটা কার দোষ সেই হিসাব খুবই সহজ।

২. ভাইরাস ও স্বাধীনতাঃ

সবাই মুক্তি বা স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা রাখে, কেউ সহজে ছেড়ে দেয় না। এটি “মুক্ত” বিশ্ব, “পরাধীন” বিশ্ব — উভয়ের জন্যই প্রযোজ্য। এমনকি ভাইরাসেরও ছড়ানোর ও মিউটেশনের জন্য বাহকের মুক্ত চলাচলের দরকার হয়। কিন্তু মুক্তি বা স্বাধীনতার মানেটা আসলে কী?

ভাইরাস প্রকৃতির “মুক্তিযোদ্ধা”র মত মানুষের উপর প্রতিশোধ নেয় এবং তাদের জীবন ও স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করে। আমাদের এর বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে, এবং পাশাপাশি আত্মসমালোচনা ও আত্মশুদ্ধি করতে হবে।

পুঁজিবাদী বিশ্বের অগ্রাধিকার পুঁজির স্বাধীনতা; আর্থিক লেনদেন, বৈশ্বিক বাণিজ্য, বাজার প্রতিযোগিতা — সবই অপরিহার্য, কোনটাই থামবে না। পুঁজিভবন গ্যারান্টি দেয় সীমাহীন তেল, কয়লা ও খনিজ, পানিদূষণ, বায়ুদূষণ, বন ধ্বংসকরণ, প্রাণী বিলুপ্তি এবং জীনগত রূপান্তরকরণের। তাদের চাহিদা মেটানোর জন্য ক্রেতারা কোন নিয়ন্ত্রণ ছাড়া যে কোন কিছু খেয়ে থাকেন— সেটা খট্টাস হোক, প্যাঙ্গোলিন হোক, আর বাদুড়ই হোক।

এই লাগামহীন স্বাধীনতার উপর প্রতিশোধ নেয় প্রকৃতি। এতো ঘনঘন হারিকেন, সর্বগ্রাসী প্রকোপ, খরা, আগুন, বন্যা, কুয়াশা এবং সংক্রামক রোগ(এইচ-১-এন-১, মার্স, ইবোলা ইত্যাদি) —এসব কি নিছক “প্রাকৃতিক”?

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলাটি পরিষ্কার হয় পিপিইর উৎপাদন ও সঞ্চলনের দিকে তাকালে। পিপিই করোনা মোকাবেলার আশু প্রয়োজনীয় অস্ত্র। মনে হচ্ছে ভাইরাসটি নিওলিবারাল বিশ্বায়নকে উপহাস করছে।

নিঃসন্দেহে পুঁজিবাদীদের কাছে শ্রমিকদের জীবনের চেয়ে মুনাফা বড়। তারা গতি কমাতে একেবারেই নারাজ, থামানো তো দূরের কথা। শ্রম যখন কোয়ারান্টাইনে, উৎপাদনযন্ত্র ও শ্রমশক্তি যখন বিচ্ছিন্ন, তখন অবশ্যই অনিবার্যভাবেই পুঁজি আহরণ থেমে যায়। সেটা কি পুঁজিবাদীদের আত্মহত্যার অসহায় ভাবনা ভাবতে বাধ্য করবে না?

প্রকৃতপক্ষে, এটাই খবর চাপা দেওয়ার ও রাজনীতিতে দ্বিধার আসল কারণ, যা পরবর্তীতে উদ্দাম প্রকোপ ডেকে আনে। এই উভয়সংকট লিবারেল দুনিয়া ও “অন্যদের” জন্য একই।

চীনে এই প্রকোপ দেখা যায় দেয় বসন্ত উৎসবের(চীনা নববর্ষ) কাছাকাছি সময়ে— প্রতিবছর এ সপ্তাহে ছুটি থাকে। এটা উভয়সংকট কাটাতে কিছুটা সহায়ক হয়। এছাড়াও শুরুতেই ভুল উদ্ঘাটন, সার্স সম্পর্কে নীতিনির্ধারকদের অভিজ্ঞতা, বিজ্ঞানীদের পরামর্শকে গুরুত্বের সাথে দেখা, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সময়মত উহান ও সারাদেশ লকডাউন করাও কল্যাণকর হয়েছে। এর মধ্যেই, জং নানশাং(যিনি সার্সের অভিজ্ঞতাসহ সম্মানিত একজন শ্বাসতন্ত্র বিশেষজ্ঞও) নেতাদের এবং জনগণের মধ্যে দেবতুল্য খ্যাতি লাভ করেন।

মহামারীর মধ্যে সামাজিক মাধ্যমে একটি ছবি ছড়াতে দেখা যায়— কার্ল মার্ক্স এবং তার পাশে একটি ভুয়া উক্তি সম্বলিত, “যখন মহামারী আসে, পুঁজিবাদ এর সব সমস্যা সামনে আনে; মহামারী পুঁজিবাদের মরণ-ঘণ্টা, যখন সমাজতন্ত্র অপরিহার্যভাবে পুঁজিবাদকে প্রতিস্থাপন করে।”

এটা অবশ্যই গাঁজাখুরি যুক্তি। পুঁজিবাদের মরণ-ঘণ্টা বাজাবে সর্বহারা বিপ্লব, কোন মহামারী না। কার্ল মার্ক্স কখনো এমন অবৈজ্ঞানিক দাবি করেননি। কিন্তু চীনের সার্বিক চিত্র কিছু সামাজিক মতামত ফুটিয়ে তোলে। বলা হয় যে মহামারী যুবরাজনীতির মোড় নাটকীয়ভাবে ঘুরিয়ে দেয়— পুঁজিবাদ সম্পর্কে হতাশা যত বাড়ে, ততই বাড়ে সমাজতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা।

আদতে, প্রকৃতি নিরবিচ্ছিন্নভাবে ভাইরাস ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ জন্ম দিতে পারবে, যতক্ষণ না মানুষ “স্বাধীনতা”র সত্যিকার অর্থ পুনর্বিবেচনা করছে, পুঁজির উচ্ছেদ না করছে এবং মৌলিকভাবে মানব-চরিত্রের দ্বন্দ্বের মীমাংসা না করছে। পরিশেষে, যেমনটা রোজা লুক্সেমবার্গ বলেছিলেন, হয় সমাজতন্ত্র নয় বর্বরতা।

৩. পূর্ব ও পশ্চিমঃ

মহামারীটি যেহেতু প্রথম প্রাচ্যে দেখা যায়, পাশ্চাত্য রাজনৈতিকরা বুঝাতে চাইলো ভাইরাসটি এশিয়ানদের জন্য একটি বিশেষ কোন কিছু। অন্যদিকে প্রাচ্যের মানুষ অন্যান্য ষড়যন্ত্রতত্ব দিয়ে জবাব দিলো। ব্যাঙেরছাতার মতো বিশ্বজুড়ে বর্ণবাদী কথাবার্তা এবং ষড়যন্ত্রতত্ব গজাতে শুরু করলো। এমনকি বিভিন্ন খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপনও ভাইরাসটির সাথে জুড়ে দেওয়া হলো।

যেমন, দক্ষিণাঞ্চলের চীনারা বন্য জন্তু খায়, যেহেতু ভাইরাসটি দক্ষিণ(উহান) থেকেই শুরু হয়, পশ্চিমারা ধরেই নেয় চীনা খাদ্যাভ্যাসের জন্য এটার উৎপত্তি (যা শুধু চীনাদেরকেই সংক্রমিত করবে)। তাই তারা নিজেদের দেশে ছড়িয়ে পরার সম্ভাবনা উপেক্ষা করে যায়। চীনাদের পাল্টা-গুজব হলো ভাইরাসটির উৎপত্তি আমেরিকার বায়োকেমিস্ট্রি ল্যাবে, তাই তারা বন্য জন্তু খেয়ে যেতে পারে।

এর উপর, শুরুতে পশ্চিমারা বৈষম্যমূলক আচরণ— এমনকি মাস্ক পরা এশিয়ানদের ঘৃণা করতে শুরু করে। এই ভুল ধারণার ভিত্তি হলো, শুধু অসুস্থ মানুষই মাস্ক পরে, তাই মাস্ক পরা “অসুস্থ” মানুষজন অন্যদের জন্যও ক্ষতিকর। বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে এরকম বিশ্রী মনোভাব নেই। জাপানীরা সর্দি-জ্বর এড়াতে মাস্ক পরে, চীনারা পরে যখন বায়ুদূষণ বেড়ে যায়। তারপর মহামারী এতো তীব্র হয়ার পরে পশ্চিমারাও মাস্ক কিনা শুরু করলো, তাও আনুষ্ঠানিক নীতিমালার নির্বিশেষে। মাস্কের স্বল্পতা স্যানিটাইজার ও টয়লেট টিস্যু পর্যন্ত বিস্তার লাভ করলো। দেখা গেল জীবনের হুমকি আসায় মাস্ক বিহীনতার “সংস্কৃতি” দ্রুত পরিবর্তিত হয়ে গেল।

আরো একটি উদাহরণ, চীনের লকডাউন নীতি পশ্চিমা মিডিয়ায় সমালোচনার স্বীকার হয়েছিল। একদিকে তারা “অমানবিক” চীন সরকারে প্রতি নিন্দা জানায়, আবার অন্যদিকে “আজ্ঞাবহ, স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিহীন” চীনা জনগণকেও ভৎর্সনা করলো। আদতে অন্তত গত কয়েক মাসের জন্য এটা সত্য নয়। চীনা জনগণ বাধ্যবাধকতামূলক নীতিকে পূর্ণ সমর্থন ও সহযোগিতা করে, মূলত ২০০৩ সালের সার্স-সংকটের তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে। চীনা আমলাতন্ত্র শুরুতে মন্থর প্রতিক্রিয়া দেখালেও, দ্রুত সদস্য পরিবর্তন করায়, আমলাতন্ত্র সজাগ হয় এবং পুরো ব্যবস্থা সুন্দরভাবে কাজ করে।

সরকারের কাছে জনগণের সম্পদ অর্থাৎ অর্থ আর যোগান, স্বাস্থ্যকর্মীদের আছে জ্ঞান, এবং জনগণ দিয়েছে তাদের শক্তিশালী সামাজিক সমর্থন — তিনটি জিনিস একত্রে কার্যকর যোদ্ধাদলের মতো যুদ্ধ জিততে পারলো।

জনস্বাস্থ্য প্রচারণা এখন পর্যন্ত কার্যকরী হয়েছে, এবং সাধারণ জনগণ সন্তুষ্ট। পার্টি ও সরকার শুরুতে পয়েন্ট হারায়, কিন্তু পরে পুষিয়ে নেয়। তার মানে এই না যে, জনগণের সর্বোপরি মতামত পরিবর্তন হয়েছে এবং তারা সরকারের উপর উদার ও অনুগত থাকবে।

উহান শহরের পার্টি সম্পাদক একটি বিশাল “ধন্যবাদ” শিক্ষার পরিকল্পনা করেছিলেন, তিনি চান উহানের মানুষ পার্টি ও নেতৃত্বকে ধন্যবাদ জানাবে। মানুষ এটা এতোই অপছন্দ করে যে কর্মতারার এটা নিয়া আর কথায় বলে না।

জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের মহামারীর আগের এক মূল্যায়ন অনুযায়ী, মহামারী মোকাবেলার ক্ষমতায় যুক্তরাষ্ট্র ছিল সর্বোৎকৃষ্ট, যেখানে চীনের অবস্থান ছিল ৫৪ তম। চীনা বিশেষজ্ঞরাও বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের মেডিকেল দক্ষতা চীনের চেয়ে অনেক ভাল।

আন্দাজ করা যায়, ১৪০ কোটি মানুষের এবং তুলনামূলক নিম্নমানের স্বাস্থ্যখাতের চীনের মত দেশে, যদি অপ্রশমিত প্রকোপ দেখা যেত, যেটা পশ্চিমে এখন হচ্ছে, তাহলে পরিণামে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসতো। চীনারা ইতিমধ্যেই স্বস্তি অনুভব করছে।

ভাইরাসটির বিরুদ্ধে লড়াই চলাকালে ৩ টি ব্যাপারে গুরুত্ব দেওয়া উচিৎঃ

  1. জাতীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উহানকে সহায়তা দেয় এবং পাবলিক মালিকানার হাসপাতালগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। চীনে হাসপাতালগুলোর ব্যাপক বেসরকারিকরণ হয়ে আসছে। ২০১৭ পর্যন্ত মাত্র ৩৬% হাসপাতাল পাবলিক, এবং উহানে সংখ্যাটা আরো কম, ২৩%। ১ কোটি জনসংখ্যা বিশিষ্ট উহানে ৯৮ টি পাবলিক ও ২৫৮ টি প্রাইভেট হাসপাতাল আছে। মহামারীতে পাবলিক হাসপাতালগুলো হয় অযোগ্য ছিল, নয় রোগীদের জন্য দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। জাতীয় সহায়তা ছাড়া পাবলিক হাসপাতালগুলো অবস্থা সামলাতে পারতো না।
  2. পুরো সময়ে বিনামূল্য টেস্ট ও চিকিৎসা। এই নীতি নিশ্চয়তা দেয়, যার হাসপাতালে যাওয়া উচিৎ সে যাবে, যার চিকিৎসা পাওয়া উচিৎ সে পাবে।
  3. শেষত, সংক্ষেপে চীনা চিরাচরিত ও পশ্চিমা চিকিৎসা নিয়ে কথা বলা যাক। এই দুই ধরণের চিকিৎসার যুগপৎ ব্যবহার উপকারী প্রমাণিত হয়েছে। পশ্চিমা চিকিৎসার মুনাফা ও একতরফা ব্যবসার করণে, চিরাচরিত চিকিৎসাকে অনেক দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে। মহামারীতে পশ্চিমা ওষুধ ও যন্ত্রপাতির অভাবে চিরাচরিত চিকিৎসার ভূমিকা ছিল।
    কিছুদিন আগে, চীনা বিজ্ঞান একাডেমীর ফেলো এবং প্রধান গবেষক তং শাওলিন কিছু জিনিস প্রকাশ করেন। সেগুলো দেখায় চিরাচরিত চিকিৎসা, মৃদু ও তীব্রভাবে আক্রান্ত রোগী এবং সুস্থ মানুষের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। চীনা চিরাচরিত চিকিৎসাবিদ্যা পুরো সময়ে কার্যকর হয় এবং ভাইরাসের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক লড়াই প্রচেষ্টায় মৌলিক অবদান রাখে।

-চেন এ. এফ. (৫৫ বছর বয়স্ক চীনা মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী-মাওবাদী)
৬ এপ্রিল ২০২০

Source: https://www.facebook.com/notes/বিপ্লবী-ছাত্র-যুব-আন্দোলনrevolutionary-student-youth-movement/কোভিড-১৯-মহামারীঃ-চীন-খোলসের-আড়ালের-বাস্তবতা/2579282215645883/