করোনাকালে বিশ্ব ও আঞ্চলিক রাজনীতির কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়

১। চীন-ভারত সংঘর্ষ ও যুদ্ধ-উত্তেজনা:

করোনাকালে ভারত-চীন সীমান্ত লাদাখে গত ১৫ জুন সশস্ত্র সংঘর্ষ হয়েছে যাতে অন্তত ২০ জন ভারতীয় সেনা নিহত, প্রায় ৭৬ জন আহত ও অন্তত ১০ জন চীনের হাতে গ্রেফতার হয়। ভারতের দাবি অনুসারে তারাও প্রায় ৫০ জন চীনা সেনাকে হতাহত করেছে। (বুর্জোয়া রাষ্ট্রগুলো যুদ্ধের সময় সর্বদাই মিথ্যা তথ্য দেয়। ভারত বলেছে তারা চীনকে উচিত শিক্ষা দিয়েছে। আবার প্রচার দিচ্ছে যে, চীন ভারতের জমি দখল করে রেখেছে।)
১৯৭৫ সালের পর বিগত ৪৫ বছরে এটাই এ ধরনের সংঘর্ষ। এটা দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক পরিস্থিতি ও তার সাথে যুক্তভাবে আমাদের দেশেরও রাজনীতি-অর্থনীতির উপর বড় ধরনের প্রভাব রাখবে বলে ধারণা করা যায়।
এটি আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্বের তীব্র হয়ে ওঠা, বিশেষত চীন-মার্কিন দ্বন্দ্ব, তার সাথে সম্পর্কিত, এবং তাকে সেটা আরো তীব্র করে তুলছে। এটি আগামীতে মার্কিন নেতৃত্বাধীনে একমেরু সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের ‘বহুমেরু বিশ্বে’ বিভক্তিকেও তরান্বিত করবে।

* ১৯৭৬ পর্যন্ত চীন যখন প্রকৃত একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ ছিল তখন মার্কিন ও সোভিয়েত সাম্রাজ্যবাদের মদদে ভারত চীনের বিরুদ্ধে অব্যাহত ষড়যন্ত্র চালিয়েছিল ও তাকে ধ্বংস করার জন্য চীনের বিরুদ্ধে একাধিকবার আগ্রাসী আক্রমণ করেছিল। ভারত ১৯৬২ সালে এই গালোয়ান উপত্যকাতেই সংঘর্ষের সূত্র ধরে মার্কিনের উস্কানিতে চীন আক্রমণ করেছিল, কিন্তু সমাজতান্ত্রিক চীনের হাতে পুরোপুরি পরাজিত হয়েছিল। পরে ১৯৬৫ সালে সে পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ বাধায়। এবং ১৯৭১ সালে পূর্ব বাংলার অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি ও তৎকালীন মার্কিন-সোভিয়েত দুই পরাশক্তির দ্বন্দ্বের সুযোগে পাকিস্তানকে আক্রমণ করে পূর্ব বাংলাকে পাকিস্থান থেকে বিচ্ছিন্ন করতে সক্ষম হয়। এগুলো প্রধানত ভারতের প্রধান শত্রু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে চালিত হলেও এ অঞ্চলে সমাজতান্ত্রিক চীনের প্রভাব কমানোর প্রচেষ্টার সাথেও যুক্ত ছিল।
শুধু পাকিস্তানই নয়, এ অঞ্চলে সকল প্রতিবেশি দেশের বিরুদ্ধে ভারত তার সম্প্রসারণবাদী কার্যক্রম দ্বারা সবগুলো দেশের জাতি ও জনগণ দ্বারা চরমভাবে ঘৃণীত। এবং ভারতীয় শাসকশ্রেণির সবগুলো দল, তাদের সংশোধনবাদী লেজুড়গুলোসহ, এই সম্প্রসারণবাদী অপতৎপরতার সক্রিয় সমর্থক।
চীনের সাথে ভারতের যুদ্ধ তৎপরতা হলো ভারতের দিক থেকে তার সম্প্রসারণবাদী অপতৎপরতার অংশমাত্র।
বর্তমানে চীন-বিরোধী এ যুদ্ধ-তৎপরতার পিছনে তার সক্রিয় সমর্থক হলো মার্কিনী ট্রাম্প প্রশাসন, যেকিনা চীনকে দুর্বল করার জন্য ভারতকে ব্যবহার করতে সচেষ্ট। ভারতে মোদি সরকারও ক্রমবর্ধিতভাবে মার্কিন-চীন দ্বন্দ্বে মার্কিনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে।

* অন্যদিকে আজকের চীনও সমাজতান্ত্রিক নয়, বরং সে হলো একটি নব্য উদীয়মান সাম্রাজ্যবাদী শক্তি, যে কিনা এখন বিশ্ব-প্রভুত্ব নিয়ে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী গুরু মার্কিনের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত। সুতরাং চীনের পক্ষ থেকে আজকের যে যুদ্ধ সেটাও এ অঞ্চলে তার সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য বিস্তার এবং আরো বৃহত্তর পরিসরে বিশ্ব-পরিস্থিতিতে মার্কিনের সাথে তার দ্বন্দ্বের ক্ষেত্রে নিজ অবস্থানকে সুবিধাজনক অবস্থায় এগিয়ে রাখার অপচেষ্টা মাত্র।

* সুতরাং আজকের চীন-ভারত যুদ্ধ-উত্তেজনা হলো একদিকে ভারতের সম্প্রসারণবাদী ও অন্যদিকে চীনা সাম্রাজ্যবাদী এই দুই প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির মধ্যকার আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বে দুই দেশেরই জনগণের কোনো স্বার্থ নেই। এ অঞ্চলের কোনো দেশের কোনো জনগণেরও কোনো স্বার্থ নেই।
এই দেশ দুটোর জনগণের করণীয় হলো, নিজ নিজ দেশে ‘পরাজয়বাদী’ লাইন গ্রহণ করা, এবং এই প্রতিক্রিয়াশীল দ্বন্দ্বে শাসকশ্রেণির দুর্বলতাগুলোর সুযোগ নিয়ে নিজেদের বিপ্লবী আন্দোলনকে শক্তিশালী করা।
সেটা অবশ্য দুই দেশেই তথাকথিত ‘দেশদ্রোহীতা’র তকমা দিয়ে শাসকশ্রেণি ও রাষ্ট্রের আক্রমণের মুখে পড়তে বাধ্য। ভারতে ইতিমধ্যেই শাসকশ্রেণির সব পার্টি এক হয়েছে এক ‘চীন-বিরোধী’ হুজুগ তুলে এবং তাকে পরিচালিত করতে চাচ্ছে প্রকৃত সমাজতান্ত্রিক ও মাওবাদী শক্তির বিরুদ্ধে, যারা কিনা এই দ্বন্দ্বে জনগণের স্বার্থকে তুলে ধরতে সক্ষম। আমাদের এই উগ্র জাতীবাদী ফ্যাসিবাদকে সংগ্রাম করতে হবে।

* চীন-ভারত দ্বন্দ্বে মার্কিন ও রাশিয়া এই দুই বিশ্বশক্তিই নিজেদের প্রভাব বাড়িয়ে তোলার কারসাজিতে ব্যস্ত। মার্কিন একদিকে ভারতকে উস্কে দিচ্ছে, অন্যদিকে বদ ট্রাম্প এতে মধ্যস্থতা করার আগ্রহও প্রকাশ করেছে। রাশিয়া ইতিমধ্যেই আরইসি(রাশিয়া-ইন্ডিয়া-চীন) জোটকে কাজে লাগিয়ে মধ্যস্থতায় আপার হ্যান্ডে থাকার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
মার্কিনসহ তার মিত্র সাম্রাজ্যবাদীরা এবং রাশিয়া উভয়ে ভারতকে নিজ বলয়ে টেনে রাখার বিবিধ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে এবং অস্ত্রবিক্রির সুযোগ ব্যবহারের মওকা পেয়েছে। ইতিমধ্যে ‘পরাশক্তি’ প্রয়াসী সাম্রাজ্যবাদ নির্ভর ভারত এই উভয় গোষ্ঠীর কাছ থেকে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার অস্ত্র বায়না দিয়েছে। একইসাথে নিজেদের চীন-বিরোধী বড়শক্তি দেখাতে গিয়ে দেশে চীনা-পণ্য বর্জনের ডাক দিয়েছে। এগুলো করে তারা সাম্রাজ্যবাদের পশম ছিঁড়তে তো পারবেই না, কারণ তারা নিজেরাই সাম্রাজ্যবাদ-নির্ভর এক রাষ্ট্র। বিপুল সাম্রাজ্যবাদী অস্ত্র কেনা এবং চীনা-পণ্য বর্জনের ডাক ব্যর্থ হবার মধ্য দিয়ে যেটা ইতিমধ্যেই প্রমাণিত হচ্ছে। উপরন্তু, এসবের মধ্য দিয়ে তারা এই করোনাকালে আরো বৃহত্তর অর্থনৈতিক সংকট ডেকে আনছে যার পুরো চাপটা পড়বে সেদেশের সাধারণ জনগণের উপর, এবং প্রতিবেশি ছোট দেশগুলোর উপর।

* সার্বিক কোনো যুদ্ধ বেধে যাবে কিনা সেটা বহু বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত। বাস্তবে এটা শুধু চীন-ভারত বা আঞ্চলিক দ্বন্দ্বের পর্যায়ে থাকতে পারে না, এবং নেইও। ইতিমধ্যেই নেপাল জনগণের চাপে এবং বর্তমান শাসকদের চীনাপন্থী অবস্থানের সুযোগে নেপাল নিজ মানচিত্র সঠিকভাবে উপস্থাপন করেছে, যাতে ভারতের সাথে তার বিতর্কিত তিনটি এলাকায় তাদের সার্বভৌমত্ব দাবি রয়েছে। এটা নেপালি জনগণের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল।
চীন পরিষ্কারভাবে বলেছে চীন পাকিস্তান নয়। ভারতও সেটা জানে। তাই, এসময়টাতে সে নেপালের ঔদ্ধত্য সত্ত্বেও কোনো পদক্ষেপে যেতে পারছে না। এই তেতো বড়িটি খেয়েও ভারত নীরব রয়েছে শুধু চীনের সাথে নেপালের ক্রমবর্ধিত সম্পর্কের ভয়ে। বরং ভারত আপাততঃ নেপালে শাসক-বদলের মাধ্যমে পরিস্থিতি তার দিকে হেলানোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, যা তার দুর্বল অবস্থানকেই প্রকাশ করছে।
এই সুযোগে চীন নেপাল সন্নিহিত আরেকটি উত্তেজনার জায়গা দোকলামে তার শক্তি বাড়িয়ে চলেছে। আগে থেকেই অরুণাচল চীন দাবি করে আসছিল, যা একবার সমাজতান্ত্রিক চীনের কাছে ভারত হারাতে বসেছিল, কিন্তু শান্তির স্বার্থে চীন তখন তা ছেড়ে দিয়েছিল, কিন্তু কখনো তারা দাবি ছাড়েনি। সেটা এখন আবার সাম্রাজ্যবাদী চীন জোরালোভাবে তাদের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থে তুলে ধরছে। গালোয়ানে চীন যে অংশ দখল করে ফেলেছে তাতে ভারত সামরিকভাবে গুরুতর সমস্যায় পড়ে গেছে, যাকিনা মার্কিনেরও মাথাব্যথার কারণ।
তাই, আজ হোক কাল হোক, সমস্যা আরো তীব্র হবে। কিন্তু এখনি যুদ্ধ বেধে যাবার সম্ভাবনা হয়তো কম। তবে এটা মার্কিনের উস্কানির সাথেও অনেকটা জড়িত। তারা ভারতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে চীন-বিরোধী সংঘাত বাড়িয়ে নিতে চাইবে। চীনকে ব্যস্ত রাখতে চাইবে। অস্ত্র বিক্রি বাড়াতে চাইবে।
অন্যদিকে রাশিয়ার সমঝোতা প্রচেষ্টা কাজে দিতেও পারে, যদি ভারতের শাসকশ্রেণির রুশ-পন্থী অংশগুলো মোদি-সরকারের উপর বড় চাপ দিতে পারে। এবং ভারত মার্কিন-প্রশাসনের বর্তমান সংকট (বিশেষত করোনা ও বর্ণবাদবিরোধী গণবিদ্রোহের কারণে, সামনে নির্বাচন থাকাতেও) এবং চীন ‘পাকিস্তান নয়’ এই সত্যকে উপলব্ধি করে আপসে রাজী হওয়াকে ভাল মনে করতে পারে। রাশিয়া এর সুযোগ নিতে চাইবে; অস্ত্র বিক্রির মাধ্যমে ইতিমধ্যেই যার আলামত দেখা যাচ্ছে।
তবে ঘটনাপ্রবাহ সাম্রাজ্যবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীলদের পরিকল্পনা মত প্রায়ই এগোয় না। তাদের মূলগত দ্বন্দ্ব তাদের অনিচ্ছার জায়গায় পরিস্থিতিকে বিকশিত করতে পারে। সেই সম্ভাবনা বাড়ছে। এটা আমরা আরো বুঝতে পারবো যদি আমরা বিশ্ব-পরিসরে ক্রমবর্ধমান চীন-মার্কিন দ্বন্দ্বের পরিস্থিতিটিকে মনে রাখি।

* বাংলাদেশের শাসকশ্রেণি, বিশেষত আওয়ামী সরকার এ অবস্থায় একটি বড় সংকটে পড়েছে। একদিকে তারা ভারতের মদদে ক্ষমতাসীন। ভারতের বিরুদ্ধে যাওয়া হাসিনা সরকারের জন্য খুব কঠিন, নিজ গদিকে হুমকিতে ফেলা। কিন্তু একইসাথে চীনের সাথেও বহু ধরনের অর্থনৈতিক সম্পর্কে তারা জড়িয়ে রয়েছে। হাসিনার সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন পদ্মা সেতুটি পর্যন্ত মার্কিনের বিরুদ্ধে চীনা ঘনিষ্ঠতার উপর নির্ভরশীল। তারা এর আগে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পুলাওয়ামার সংঘর্ষ ও কাশ্মীর বিষয়ে ৩৭০ ধারা সংশোধনে ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’-এর অজুহাতে ভারতকে সমর্থন করলেও এবার তারা এখনো পর্যন্ত মুখ বন্ধ করে রয়েছে। ‘আমরা শান্তি চাই’ জাতীয় কিছু বচন ছাড়া ব্যতীত তাদের তেমন কোনো ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না। তবে তাদের থিংক ট্যাংক’রা উভয়ের সাথে ভারসাম্য বজায় রাখার নসিহত করে যাচ্ছে, যা বিশ্ব-পরিসরে দ্বন্দ্বের আরো বিকাশের পরিস্থিতিতে সম্ভব না হতে পারে। বিশেষত, হাসিনা সরকারের জন্য, যারা ভারতের মদদ ছাড়া সরকার টিকিয়ে রাখা কঠিন। কিন্তু এটা হাসিনা সরকারের অভ্যন্তরে দ্বন্দ্বকে বৃদ্ধি করতে পারে, যাতে জেনুইন ভারতপন্থীরা নিরপেক্ষ থাকার বিরুদ্ধে মাঠে নামতে পারে। ইতিমধ্যেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছে যে, বাংলাদেশের মত বন্ধু ভারতের আর কেউ নেই।
যদি চীন-ভারত দ্বন্দ্ব আরো তীব্র হয়, এমনকি যুদ্ধ বেধে যায়, বিশেষত সে কারণে যদি ভারতের সাথে মার্কিনের সম্পর্ক আরো জোরদার হয়ে ওঠে, চীনের বদলে, তাহলে আওয়ামী-হাসিনা সরকার গুরুতর বিপদে পড়বে তাদের প্রভু নির্ধারণের বিষয়ে। চীনের সাথে ঘনিষ্ঠতা তার জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে এবং ভারত-মার্কিন এখানে তাদের অনুকূলে শাসক-বদলের উদ্যোগ নিতে পারে। যেটা তারা এতদিন ধরে নিরংকুশভাবে হাসিনা-আওয়ামী লীগকে দিয়ে গেছে এবং এর ফলেই তারা ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে পারছে।
আবার তারা যদি চীনকে বর্জন করে তাহলে অর্থনৈতিক সংকট তার আরো বাড়বে, এবং চীনও শাসক-বদলে সক্রিয় হতে পারে, যা এতদিন সে করেনি। তবে শাসক-বদলে চীন থেকে মার্কিনীরা অনেক বেশি দক্ষ ও অভিজ্ঞ।
উপরন্তু, করোনাকালে যে গুরুতর অর্থনৈতিক সংকটের মুখে সরকার পড়তে চলেছে, তাতে যে জনবিক্ষোভের বৃদ্ধি ঘটে চলেছে, সরকারের গণবিরোধিতা ও ব্যর্থতা যেভাবে প্রকাশিত হয়ে চলেছে, তা শাসকশ্রেণির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বকে যেভাবে বাড়িয়ে তুলছে, তাতে এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে বিরোধী পক্ষগুলো সরকার ফেলে দেয়ার বিভিন্নমুখী ‘ষড়যন্ত্রে’ বিশেষভাবে সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে।
আমাদের উচিত হবে শাসকশ্রেণির অভ্যন্তরে বেড়ে চলা দ্বন্দ্বকে কাজে লাগানো, পরিস্থিতির সুযোগ নেয়া এবং ভারতের সম্প্রসারণবাদী ও চীনের বর্তমান সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র এবং মার্কিন-চীন তথা আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্বকে উন্মোচন করা; জনগণকে সঠিক পথ দেখানো।

২। আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্ব আরো তীব্র হচ্ছে:
করোনা আক্রমণের পূর্বেই চীন-মার্কিন দ্বন্দ্ব বিশ্বপরিসরে তীব্র হয়ে উঠছিল। চীন নব্য সাম্রাজ্যবাদ হিসেবে আবির্ভূত হওয়া এবং একটি বৃহৎ অর্থনৈতিক (ও সামরিক) শক্তি হিসেবে মার্কিনের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হওয়ায় এটা অনিবার্য ছিল। চীন বহুমেরু বিশ্বের স্লোগান সামনে আনে বিশ্বকে ভাগাভাগি করার জন্য। মার্কিন তার একক কর্তৃত্ব খর্ব হবার আশংকায় একে প্রতিরোধ করতে চায়, বিশেষত ফ্যাসিবাদী ট্রাম্প প্রশাসন। তারা দক্ষিণ-চীন সাগরে নিজ শক্তি প্রদর্শন করে, হংকংয়ে চৈনিক-স্বৈরাচার বিরোধী গণআন্দোলনে নিজ অনুপ্রবেশ ঘটায় ও বুর্জোয়া উস্কানি দেয়, এমনকি রাশিয়া-চীনের মিত্র পারমাণবিক শক্তিধর উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে একের পর এক হুমকি জারি রাখে, ইরানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চালাতে থাকে।
কিন্তু করোনাকালে সাম্রাজ্যবাদী সকলের, বিশেষত মার্কিনের সংকট গুরুতরভাবে বেড়ে গেছে, বিশেষ করে আগামীতে বড় ধরনের অর্থনৈতিক মন্দার পূর্বাভাষ পাওয়া যাচ্ছে। এ অবস্থায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ চীন-বিরোধী তার তৎপরতা আরো বৃদ্ধি করেছে। প্রথমে করোনার জন্য সে চীনকে দায়ী করে। তারপর সে নিজ করোনা প্রতিরোধে ব্যর্থতা প্রদর্শনের পর, পাশাপাশি চীন তাতে সাময়িকভাবে হলেও সফল হবার পর, ট্রাম্প প্রশাসন চীন-বিরোধী তৎপরতাকে আরো বৃদ্ধি করে। এতদিন যে জাতিসংঘ মার্কিনের স্বার্থে কাজ করেছে তার স্বাস্থ্য-বিভাগ(বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাÑ হু)-কে চীনের দালাল বলে গালি দিতে থাকে। এবং এক পর্যায়ে সেখানে মার্কিনের অনুদান (মোট অনুদানের ১৫%; প্রায় ৪০ কোটি ডলার) বন্ধ করে দেয়। (ঠিকই-তো, আমার টাকা খাবি, আর দালালী করবি চীনের!) এসবই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে আন্তর্জাতিক বুর্জোয়া মহল থেকে বেশ পরিমাণে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। রাশিয়া এ পদক্ষেপের নিন্দা করেছে, জার্মানি ও ইইউ একে সমালোচনা করেছে, আর চীন হু-কে সমর্থন করেছে। এসবের পেছনে আমেরিকার আসন্ন নির্বাচনে ট্রাম্পকে জেতানোর ফ্যাসিবাদী কৌশল থাকলেও একইসাথে গোটা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা এই সুতীব্র দ্বন্দ্বকে সামাল দিতে সক্ষম নয়। বরং তারা একে বৃদ্ধি করতেই বাধ্য।
যার প্রকাশ আমরা দেখি চীন-ভারত যুদ্ধ-উত্তেজনার মধ্যে মার্কিনের নাক গলিয়ে ভারতকে উস্কে দেয়ার কার্যক্রমে। যদিও তার অপর প্রতিদ্বন্দ্বী রাশিয়ান সাম্রাজ্যবাদ ইতিমধ্যেই (২৩ তারিখে) বলেছে যে, চীন-ভারত দ্বন্দ্বে বাইরের কারও মধ্যস্থতার দরকার নেই, তারা নিজেরাই সমঝোতা করতে সক্ষম। বাস্তবে মার্কিনের বিরুদ্ধে এটা রাশিয়ার মোড়লিপণার একটা প্রকাশ মাত্র। এটা রাশিয়ার সাথেও মার্কিনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও তাতে মার্কিনের দুর্বল অবস্থানকে প্রকাশ করছে।
রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ জায়গা থেকে খোদ বিলগেটসকে করোনার জন্য দায়ী করে বলা হয়েছে, সে আগেই এটি জানতো, তার ভ্যাকসিন ব্যবসার স্বার্থে সে আগে এটা বলেনি।
করোনার অভিঘাতে যে অর্থনৈতিক মন্দার আভাষ পাওয়া যাচ্ছিল তার ব্যাপকতা, প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া কতটা ঘটবে সেটা বুর্জোয়া অর্থনীতিবিদরাও নিশ্চিতভাবে বলতে পারছেনা। কিন্তু বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতি বড় ধরনের সংকটে পড়বে এটা সর্বজনস্বীকৃত একটি বিষয়। এই সংকট আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্বকে বৃদ্ধি করতে থাকবে। যা বিবিধ প্রক্সি যুদ্ধ সৃষ্টি করতে পারে, এমনকি সেটা যদি করোনা-বোমা বা করোনা-যুদ্ধ আকারে ফেটে পড়ে তাতেও অবাক কিছু থাকবে না।
ইতিমধ্যে করোনার অজুহাতে চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে বিমান যাওয়াকে নিষিদ্ধ করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। হংকংয়ে ব্রিটেন উস্কানি দিচ্ছে বলে চীন অভিযোগ করেছে ও যুক্তরাজ্যকে হুঁশিয়ারি দিয়েছে। ইউরোপ থেকে মার্কিন সেনাদের বিপুল অংশকে সরিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে নেয়া হচ্ছে, যার অর্থ হলো চীনকে সামরিক হুমকি দেয়া।
করোনা-বাণিজ্যযুদ্ধ দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। ভ্যাকসিন ও ঔষধ তৈরি নিয়ে বিশ্বের বিজ্ঞানীদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার বদলে দেখা যাচ্ছে যেন তেনভাবে একে অন্যকে টেক্কা দেয়ার প্রতিযোগিতা। বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করার আগেই আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, চীন, এমনকি ভারত বা ইরানের থেকে বিভিন্ন ধরনের আবিষ্কারের দাবি করা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই এসব কম পরীক্ষিত ভ্যাকসিন ও ঔষধের পরীক্ষা করা হচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রাজিল, আমিরাতÑ এ জাতীয় সাম্রাজ্যবাদ-নিপীড়িত বিভিন্ন দেশে। জানা যাচ্ছে যে, আইটি বিলিয়নিয়র বিল গেটস শত শত কোটি ভ্যাকসিন/ঔষধ বাজারজাত করার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। আমেরিকা, ব্রাজিল, ভারত বা বাংলাদেশের মত দেশগুলোতে যে করোনা প্রতিরোধের ক্ষেত্রে ভাল কোনো প্রস্তুতি নেয়া হয়নি বা পদক্ষেপ নেয়া হয়নি তার পিছনে ব্যাপক হারে আক্রান্ত হওয়া এবং বিশ্বের সকল মানুষের কাছে ভ্যাকসিন ও ঔষধ বিক্রির ষড়যন্ত্র ক্রিয়াশীল থাকলে সেটা অবাক হওয়ার বিষয় হবে না।
এটা পরিষ্কার হয়ে উঠছে যে, করোনা নিয়ে সাম্রাজ্যবাদীদের ও তাদের দালালদের বাণিজ্য-যুদ্ধ আরো বৃদ্ধি পাবে, যা আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্বকে আরো তীব্র করে তুলবে। যার বলি তারা করবে বিশেষত ৩য় বিশ্বের জনগণকে। পণ্যের বাজার তৈরি দ্বারা ও যুদ্ধ-কার্যক্রম, অস্ত্র বিক্রি দ্বারা।
জনগণকে অবশ্যই এসবকে উন্মোচন করতে হবে। আমাদের দেশে দেশবিরোধী বিদেশি দালাল শাসকশ্রেণি ও সরকার দ্বারা উপরোক্ত অপতৎপরতায় সামিল হওয়াকে সংগ্রাম করতে হবে।

৩। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি খেয়ে গেল;
এখনো চলছে সে ভূমিকম্প:
মার্কিন পুলিশ কর্তৃক সেদেশের এক মধ্যবয়সী আফ্রিকান-আমেরিকান (সাধারণভাবে কৃষ্ণাঙ্গ বলে অভিহিত) নাগরিক জর্জ ফ্লয়েডকে নির্মমভাবে প্রকাশ্যে হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে গণবিদ্রোহ আমেরিকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল এমাসেই, তাকে বলা হচ্ছে বিগত ষাট-দশকের পর সর্ববৃহৎ। তার সমর্থনে সমস্ত শেতাঙ্গ সাম্রাজ্যবাদী দেশেও আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। প্রথম দিকে সাম্রাজ্যবাদীরা বিশেষত ট্রাম্প ও বুর্জোয়া মিডিয়া একে ‘দাঙ্গা’ বলে অভিহিত করতে চাইলেও অল্প পরেই তাকে ‘কৃষ্ণাঙ্গ বিদ্রোহ’ নামে চিহ্নিত করতে চায়। কিন্তু সমস্ত তথ্য ইতিমধ্যেই দেখিয়ে দিয়েছে, সবচেয়ে নিপীড়িত জনগোষ্ঠী হিসেবে কৃষ্ণাঙ্গরা এ বিদ্রোহ ও আন্দোলনের প্রধান শক্তি হলেও এটি ছিল ও রয়েছে একটি গণবিদ্রোহÑ বণবাদবিরোধী গণবিদ্রোহ। সাম্রাজ্যবাদী ও বুর্জোয়া মিডিয়াগুলো জনগণের প্রকৃত বিদ্রোহগুলোকে সর্বদাই বিকৃতভাবে চিত্রিত করতে চায়।

এই বিদ্রোহ ও আন্দোলন গণমানুষের, বিশেষত কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের মুক্তি এনে দেবে সেটা আশা করাটা ভুল হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত না রাষ্ট্রক্ষমতার গুণগত রূপান্তরের কর্মসূচির ভিত্তিতে কোনো বিপ্লবী রাজনৈতিক শক্তি তাতে নেতৃত্ব না দেয় ততদিন সেটা মানুষের মুক্তি এনে দেয়না। কিন্তু গণমানুষের এমন আন্দোলন শাসকদেরকে বাধ্য করে কিছুটা সংস্কার করতে। সেটা চলছে। ইতিমধ্যেই আন্দোলনকে ঠান্ডা করা এবং নিজেদেরকে আক্রমণের মুখ থেকে রক্ষা করা, একইসাথে নিজেদের বাজার ঠিক রাখার জন্য তারা কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছে। যেমন, ‘ফেয়ার এন্ড লাভলি’ রং ফর্সা করার ক্রিম তাদের এ পণ্যের নাম থেকে ফেয়ার(ফর্সা) শব্দটি বাদ দিচ্ছে। ইংল্যান্ডে ১০০ বছর আগে এক ফুটবালারকে তার গায়ের কালো রঙের কারণে জাতীয় টিম থেকে বের করে দেয়ার জন্য তারা দুঃখ প্রকাশ করছে।
কিছু বিদ্রোহী কর্মকান্ডকে সাম্রাজ্যবাদীরা আপাতত মেনে নিচ্ছে। যেমন, মূর্তি ভাঙ্গা কার্যক্রম। শত বছরের আইকন, যারা ছিল আসলে বর্ণবাদী, তাদের মূর্তি ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে। আমেরিকায় জেফারসন (জাতির অন্যতম প্রধান স্থপতি), ওয়াশিংটন (জাতির পিতা)সহ ইংল্যান্ডে কিছু দাসব্যবসায়ীর উঁচু করা মাথা ভাস্কর্য থেকে কেটে দেয়া হয়েছে। এমনকি ২য় বিশ্বযুদ্ধে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের মূর্তি পর্যন্ত ভাঙ্গার প্রচেষ্টা চলেছে।
যাহোক, এধরনের আন্দোলন দীর্ঘদিন জিইয়ে থাকতে পারেনা। একসময়ে থিতিয়ে আসে। কিন্তু প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের মত ব্যবস্থার উপর বড় আঘাত হেনে যায়। যার থেকে প্রকৃত সমাজ পরিবর্তনকামীরা অনেক শিক্ষা ও সুযোগ গ্রহণ করতে পারে।

* এই বিদ্রোহকে শুধু কৃষ্ণাঙ্গ সমস্যা উদ্ভূত হিসেবে দেখলে ভুল হবে। একদিকে মার্কিন দেশে ক্রমবর্ধমান ফ্যাসিবাদী আক্রমণ (যার নেতৃত্ব দিচ্ছে কুখ্যাত ট্রাম্প)। অন্যদিকে করোনা-ঝড়ে সাম্রাজ্যবাদের অর্থনৈতিক মন্দা ও আগামীতে আরো বড় সংকটের সম্ভাবনাÑ যার মাসুল দিতে হচ্ছে ও হবে সাধারণ জনগণকে। বিপুল তরুণ ও শ্রমজীবীকে চাকরি হারাতে হয়েছে। আরো হারাবে। এর উপর রয়েছে করোনার চিকিৎসায় আমেরিকার মত বড় অর্থনীতির ব্যর্থতা, জনগণের চরম দুর্ভোগ। উপরন্তু সমগ্রভাবেই পুুঁজিবাদের সংকটে জনগণের জীবন-জীবিকার অনিশ্চয়তা। রাষ্ট্রের কেন্দ্রে ফ্যাসিবাদের বিকাশে জনগণের জন্য বরাদ্দ রাষ্ট্রীয় বরাদ্দের কাট-ছাট। তাদের উপর নেমে আসা অপমান ও অত্যাচার।
এই সমস্ত কিছুর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার অভিঘাত এই বিদ্রোহে জ্বালানি যোগান দিয়েছে। জনগণ, এমনকি আমেরিকাতেও ক্ষুব্ধ, আন্দোলনমুখী। সুতরাং করোনা যে শুধু সংকট নয়, সার্বিক পরিবর্তনের একটি ডাক দিচ্ছে ও সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে তাকে উপলব্ধি করাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশের বাহ্যত শান্তিপূর্ণ অবস্থাও হঠাৎ করেই যেকোনো স্ফুলিঙ্গ পেলে দাবানল হয়ে উঠতে পারে। সম্ভাব্য এ অবস্থার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত থাকতে হবে। ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ছে। দেশে ও বিশ্বে। তাকে গুছিয়ে ওঠার সুযোগ না দিয়ে তাকে ধ্বংস করতে হবে একটি প্রগতিশীল কর্মসূচি দ্বারা।

* আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ বিশ্ব-পুঁজিবাদ ও বিশ্ব বুর্জোয়া-গণতন্ত্রের প্রভু। কিন্তু তাদের এ গণতন্ত্র যে বর্ণবাদকে পোষণ করে সেটা খুলে দেখানো দরকার। আজ আমেরিকান ‘সমৃদ্ধি’র ভিত্তি কী? সেটা হলো তিনটি মানবতাবাদবিরোধী বর্বর বর্ণবাদী ব্যবস্থা থেকে সঞ্চিত বিপুল অন্যায় সম্পদ। এক, সমগ্র আমেরিকান আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে ইউরোপীয় উঠতি বুর্জোয়াদের দ্বারা হত্যা করা ও তাদের সম্পদ ও দেশকে দখল করে নেয়া। দুই, আফ্রিকা থেকে কোটি কোটি কালো মানুষদের ধরে এনে বন্দি করে তাদেরকে দাস বানিয়ে বিপুল সম্পদের সৃষ্টি করা বিনাপয়সায়; তিন, বিগত এক শতাব্দী ধরে সমগ্র বিশ্বজুড়ে বর্বর ও নির্মম গণহত্যা, যুদ্ধ, দখল, লুণ্ঠন, শোষণ ও নিপীড়ন করে সম্পদের পাহাড় জমানো।

* আমেরিকায় দেড়শ’ বছরের বেশি সময় আগে দাসপ্রথা উঠে গিয়েছিল। কিন্তু সেটা যে কালো নিপীড়িতদেরকে মুক্ত করেনি তা এখনো স্পষ্ট। সেখানে এখনো বস্তিবাসীদের প্রধান অংশ কালো, জেলখানাগুলোতে বন্দিদের প্রধান অংশ কালো, পুলিশের গুলিতে বিনাবিচারে হত্যার প্রধান শিকার কালো, সবচেয়ে কম শিক্ষিত জনগোষ্ঠী কালো।
একজন আধা-কালো ওবামাকে প্রেসিডেন্ট বানিয়ে, বা একজন লুথার কিংকে হত্যার পর এখন তাকে আদর্শ বানিয়ে এজাতীয় বহু সত্যকে গোপন করা যাবেনা। পুঁজিবাদের পুলিশ যে গণনির্যাতনকারী সেটা সেখানে জ্বলজ্যান্ত। আমেরিকাতে বছরে অন্তত এক হাজারের বেশি মানুষকে বিনাবিচারে বা নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়। তাই, ফ্লয়েডের ঘটনা কোনো একটিমাত্র বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। গণবিদ্রোহ কোনো একটি ঘটনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বা বিচার চাওয়া নয়। আগামীতে আমেরিকায় যদি ফ্যাসিবাদ আরো জেঁকে বসে, যার আলামত অবশ্যই রয়েছে, তাতে এই ধরনের নির্যাতন আরো বাড়বে, যাতদিন না এই মানব-শত্রু ব্যবস্থা ধ্বংস হচ্ছে।

শুধু আমেরিকা নয়, আমাদের দেশসহ পাশের দেশেও এটা চলছে। ভারতে এর মধ্যেই তামিলনাড়ুতে করোনাকালে পুলিশি অত্যাচারের বিরোধিতা করায় এক ক্ষুদ্র মোবাইল ব্যবসায়ীকে বর্বর অত্যাচার করে হত্যার পর সমগ্র ভারতে নিন্দার ঝড়া বইছে। সেখানেও ঝড়ের আভাস রয়েছে।
‘স্বাধীন’ ও ‘বঙ্গবন্ধু কন্যার’ বাংলাদেশ কেন পিছিয়ে থাকবে? সম্প্রতি তার ভদ্র নরমভাষী কূটিল তথ্যমন্ত্রী গর্বের সাথে বলেছে যে, বিএনপি’র আমলে এই ধরনের হত্যা হয়েছে বছরে তিনশ’র অধিক; হাসিনা সরকার হত্যা করছে মাত্র ১৮৭ জনকে। কতজনকে হত্যা করলে একটি প্রধানমন্ত্রী বা সরকারের ফাঁসি হতে পারে? একটি হত্যা, নাকি ৩০ লক্ষ হত্যা?
সমগ্র বিশ্বে আজ এই পরিস্থিতি চলছে। কোথাও বেশি কোথাও কম। সুতরাং বিশ্বব্যবস্থা রূপান্তরের সংগ্রাম তুলুন। এবং আরো জোরে তুলে ধরুন এ ব্যবস্থার পরিবর্তন করে আপনি কী ব্যবস্থা চান তার রূপরেখা। সমাজতন্ত্র ব্যতীত কোন ব্যবস্থাই মানবজাতিকে সমূহ বর্বরতা ও ধ্বংসের সম্ভাবনা থেকে বাঁচাতে পারবে না। আমাদের দেশে সে লক্ষ্যেই নয়াগণতান্ত্রিক বিপ্লবকে বেগবান করতে হবে।

* প্রসঙ্গত, যে আওয়ামী লীগ ও হাসিনা সরকার নিপীড়িত জনগণের জন্য সর্বদাই কুম্ভিরাশ্রু বর্ষণ করে তারা কিন্তু এখনো পর্যন্ত মার্কিনী প্রশাসনের নিন্দা করে বা বর্ণবাদবিরোধী এই বিশাল আন্দোলনকে সমর্থন করে একটি বাক্যও উচ্চারণ করেনি। এ না হলে কি আর আওয়ামী ‘মুক্তিযুদ্ধ-চেতনা’?!

কেন্দ্রীয় কমিটি, পিবিএসপি