মাওবাদী নেতা কমরেড মতিনের জীবনাবসান।।পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি(সিসি)

মাওবাদী নেতা কমরেড মতিনের জীবনাবসান

বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে যে, গত ১১ আগস্ট ২০১৯, এদেশের মাওবাদী আন্দোলনের একজন প্রধান নেতা কমরেড মতিন মৃত্যুবরণ করেছেন। বহুদিন ধরেই তিনি বিভিন্ন দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত ছিলেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল প্রায় ৬৪ বছর।
কমরেড মতিন (ওরফে শাহিন/রহমান…. পৈত্রিক নাম নিজামউদ্দিন বুলু) ছিলেন এদেশের প্রধানতম মাওবাদী বিপ্লবী পার্টি, পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা, এবং পরবর্তীকালে দেশের অন্যতম মাওবাদী কেন্দ্র এমবিআরএম-এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নেতা। তাঁর পৈত্রিক নিবাস বরিশাল। শহুরে চাকুরিজীবী মধ্যবিত্ত পরিবারে তাঁর জন্ম ১৯৫৫ সালে। স্কুলের ছাত্র অবস্থায়, ১৯৭০ সালে, মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি এদেশের প্রধান মাওবাদী বিপ্লবী পার্টি, কমরেড সিরাজ সিকদার প্রতিষ্ঠিত পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির প্রস্তুতি সংগঠন “পূর্ব বাংলা শ্রমিক আন্দোলন”-এ যোগ দেন, এবং অচিরেই সার্বক্ষণিক কর্মীতে পরিণত হন। এর পর তিনি আর পেছন ফিরে তাকাননি, এবং শেষের কয়েকটি বছর বাদে আজীবন মাওবাদী আদর্শে অবিচল থেকে বিপ্লবী কাজে জীবন অতিবাহিত করেন।

* কমরেড মতিন ১৯৭০ সালে সার্বক্ষণিক হবার পর চট্টগ্রামের গ্রামাঞ্চলে কিছুদিন কাজ করেন। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি বরিশালে ও পরে পাবনায় কাজ করেন। কিন্তু তাঁর বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ পার্টি-দায়িত্ব এসে পড়ে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর মুন্সিগঞ্জ-বিক্রমপুর অঞ্চলে, যেখানে ’৭৩-সালে পার্টির নেতৃত্বে বিপ্লবী সংগ্রামের এক বিরাট উত্থান ঘটে। সেখানেই “বাংলাদেশ” আমলে পার্টির নেতৃত্বে প্রথম সফল থানা-দখল (লৌহজং থানা) অপারেশনটি পরিচালিত হয়, যার প্রধান স্পট কমান্ডার ছিলেন কমরেড মতিন। এর পর শেখ মুজিবের ফ্যাসিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে কমরেড সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে দেশব্যাপী বিপ্লবী সংগ্রামের যে উত্থান সৃষ্টি হয় তাতে কমরেড মতিন বহু বহু গুরুত্বপূর্ণ সামরিক এ্যাকশনে নেতৃত্ব দেন, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল পরিচালনা করেন, এবং পার্টির একজন গুরুত্বপূর্ণ সামরিক-সাংগঠনিক নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কমরেড সিরাজ সিকদার পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সংকটকালে ৯ সদস্য-বিশিষ্ট একটি বিকল্প কেন্দ্রীয় কাঠামো গঠন করেছিলেন। সভাপতি, প্রধান সমন্বয়কারী ও কেন্দ্রীয় হিসেবরক্ষক ছাড়াও সেখানে কম.এসএস-এর দুটো “সাহায্যকারী গ্রুপ” ছিল (মোট ৬ সদস্যের), যার মাঝে “সামরিক সাহায্যকারী” গ্রুপের ১নং সদস্য ছিলেন কম.মতিন।

* কম.এসএস-এর নেতৃত্বাধীন সময়কালে একজন মাঠ-পর্যায়ের কর্মী, সংগঠক ও নেতৃত্ব হিসেবে উপরোক্ত উজ্জ্বল ভূমিকা সত্ত্বেও ২ জানুয়ারি,’৭৫-এ কম.এসএস-এর শহীদি মৃত্যুবরণের পর কম.মতিনের উপর যখন কেন্দ্রীয় নেতৃত্বদানের লাইনগত দায়িত্ব এসে পড়ে তখন তিনি ইতিবাচক ভূমিকার পাশাপাশি বহু গুরুতর ভুলও করেন। এরই প্রক্রিয়ায় অচিরেই তিনি শত্রুর হাতে বন্দী হন ১৯৭৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে (মোহনগঞ্জ থানা অপারেশনে গিয়ে)। কিন্তু সুদীর্ঘ প্রায় ১০ বছরাধিককালের বন্দী জীবনে তিনি মাওবাদ ও বিপ্লবের প্রতি তার আনুগত্যকে কখনো শিথিল করেননি। এবং মুক্তি পাওয়ার সাথে সাথেই পুনরায় বিপ্লবী অনুশীলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

* কমরেড মতিনের বিপ্লবী জীবনের প্রধানতম তিনটি অধ্যায় হলোÑ প্রথমত, কমরেড এসএস-এর নেতৃত্বাধীনে ’৭০-দশকের মাওবাদী বিপ্লবী সংগ্রামে যুক্ত হওয়া এবং একজন মেধাবী বিপ্লবী হিসেবে ’৭৩-৭৪ সালের বিপ্লবী উত্থানকালে পার্টির কেন্দ্রীয় স্তরের একজন সংগঠক ও সামরিক নেতৃত্ব হিসেবে গড়ে ওঠা। দ্বিতীয়ত, ’৮০ ও ’৯০-দশকে কমরেড আনোয়ার কবীরের নেতৃত্বাধীনে পার্টির দ্বিতীয় বিপ্লবী উত্থান ও পরবর্তীকালের ইতিহাসে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে ভূমিকা রাখা। তৃতীয়ত, গত শতাব্দীর শেষদিকে আমাদের পার্টি বিভক্ত হয়ে গেলে অন্য একটি মাওবাদী কেন্দ্র এমবিআরএম প্রতিষ্ঠা করা এবং ১৯৯৯ থেকে শুরু করে প্রায় ২০১৬ সাল পর্যন্ত তার প্রধান নেতা হিসেবে কাজ করা।
এছাড়াও তিনি অল্পসময়ের জন্য একবার ১৯৭৫ সালে, কমরেড এসএস-এর মৃত্যুর পর পার্টি-কেন্দ্র অসস’র প্রধান হিসেবে, এবং পরে জেলে বন্দী অবস্থায় ১৯৭৬ থেকে ১৯৭৮ পর্যন্ত তৎকালীন বিভক্ত-পার্টির একটি কেন্দ্র “সত্ত্বা”র প্রধান হিসেবে ভূমিকা রাখেন।

* কমরেড মতিন তাঁর সুদীর্ঘ বিপ্লবী জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ইতিবাচক ভূমিকার পাশাপাশি বিভিন্ন গুরুতর দুর্বলতা ও বিচ্যুতির জন্যও পার্টির ও এদেশের মাওবাদী আন্দোলনের ইতিহাসে আলোচিত হয়েছেন ও হবেন। প্রথমত, কম.এসএস-এর মৃত্যুর পর যে সংকটজনক পরিস্থিতিতে অত্যন্ত অল্প বয়সে তাঁর উপর পার্টির নেতৃত্বদানের দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল তা তিনি সঠিকভাবে পালন করতে ব্যর্থ হন। পার্টির বিপর্যয়কে মোকবিলার জন্য পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ রাখা এবং অতীত বিপ্লবী অভিজ্ঞতার লাইনগত সারসংকলন করতে না পেরে তিনি পার্টির সংকটকে বরং আরো বিকশিত করেন। গ্রেফতার হবার পর বন্দী অবস্থাতেও তিনি পার্টির সংকট মোকাবেলা করার সঠিক পথ-নির্মাণের বদলে পার্টির বিভক্তিতে ও সংকট-বৃদ্ধিতে অবদান রাখেন।
তবে জেল জীবনেই এক পর্যায়ে তিনি কমরেড আনোয়ার কবীরের নেতৃত্বাধীন পার্টি-কেন্দ্র সবিপ’র সারসংকলন প্রক্রিয়ার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে ১৯৭৮ সালে পার্টিতে ঐক্যবদ্ধ হন এবং ১৯৮৬ সালে জেল-মুক্ত হয়ে পার্টির নেতৃত্বে পুনরায় বিপ্লবী সংগ্রামে যুক্ত হন।
১৯৮৭ সালে পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসে এবং ১৯৯২ সালের তৃতীয় কংগ্রেসে তিনি সম্পাদক কম.আনোয়ার কবীরের নেতৃত্বাধীনে কেন্দ্রীয় কমিটির পূর্ণাঙ্গ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি কেন্দ্রীয় সামরিক কমিশনেরও সদস্য ছিলেন। এভাবে তিনি আমাদের পার্টির অন্যতম কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব হিসেবে পুনরায় বিশেষ মর্যাদা ও যোগ্যতায় উন্নীত হন।

* ’৯০-দশকের মাঝামাঝি থেকে আমাদের পার্টির অভ্যন্তরে বিবিধ লাইন-প্রশ্নে দুই লাইনের সংগ্রাম গড়ে ওঠে, যার প্রক্রিয়ায় ১৯৯৮ সালের মধ্যে পার্টি প্রধান তিনটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। কমরেড মতিন আমাদের পার্টি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তার অনুসারীদের নিয়ে এমবিআরএম নামে নতুন একটি কেন্দ্র গড়ে তোলেন।
বিভক্তির পরও এমবিআরএম-এর সাথে আমাদের পার্টি দুই-লাইনের সংগ্রামকে যথাসাধ্য এগিয়ে নেয়। এ শতাব্দীর প্রথম কয়েক বছরে এমবিআরএম-এর বামরূপী ডানপন্থার বিরুদ্ধে আমাদের পার্টিকে খুবই তীব্র ও তিক্ত দুই লাইনের সংগ্রাম পরিচালনা করতে হয়। যে সম্পর্কে পার্টির লাইনগত সংগ্রামের দলিলগুলো থেকে জানা যাবে। একইসাথে এ প্রক্রিয়ায় আমাদের পার্টি সকল আন্তরিক মাওবাদীদেরকে ঐক্যবদ্ধ করে একটি একক ঐক্যবদ্ধ মাওবাদী পার্টি গঠনের কার্যক্রমকেও এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা চালায়। কিন্তু কম.মতিনের নেতৃত্বে এমবিআরএম আমাদের পার্টির এসব নীতি ও কার্যক্রমকে গুরুত্ব না দিয়ে “একলা চলো”র বিভেদাত্মক নীতি অব্যাহত রাখে।
কমরেড মতিনের নেতৃত্বে এমবিআরএম প্রথম দিকে কিছু সফল সামরিক এ্যাকশনের মাধ্যমে বেশ কিছু সাড়া ও বিকাশ ঘটালেও অচিরেই মতাদর্শগত-রাজনৈতিক দুর্বলতা/বিচ্যুতিগুলোর কারণে তাদের নিজেদের অভ্যন্তরে সংকট মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। পর্যায়ক্রমে এমবিআরএম ক্ষয়ের ধারায় প্রবেশ করে, যাকে মূল্যায়ন করতে কম.মতিন ব্যর্থ হন। এক পর্যায়ে কমরেড মতিনের প্রধান সংগঠনগুলো তাকে পরিত্যাগ করে, অথবা তিনি নিজেই তাদের থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন। কার্যত ২০১৬ সালেই এমবিআরএম বিভক্ত হয়ে যায়। বিভক্ত অংশ কম.মতিনকে বিপ্লব থেকে বসে পড়া এবং ডান-বিলোপবাদে গড়িয়ে পড়ার অভিযোগে অভিযুক্ত করে। কিন্তু কম.মতিনের পক্ষ থেকে এজাতীয় গুরুতর মতাদর্শগত-রাজনৈতিক অভিযোগের কোনো আনুষ্ঠানিক জবাব পাওয়া যায়নি। যদিও এসময়ে তাঁর শারীরিক অবস্থার ক্রমাবনতি ঘটতে থাকে, কিন্তু সেটা একজন প্রধান বিপ্লবী কমিউনিস্ট নেতৃত্বের এমন রাজনৈতিক নিষ্ক্রিয় ভূমিকার পক্ষে কোনো যুক্তি হতে পারে না। বাস্তবে এরপর থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিন বছর বা তার বেশি সময় ধরে কম.মতিন রাজনৈতিক ভাবে সক্রিয় ছিলেন না বলেই প্রতিভাত হয়। এভাবে কম.মতিনের নেতৃত্বাধীন একটা সুদীর্ঘ অধ্যায়ের দুঃখজনক সমাপ্তি ঘটে।

* কম.মতিনের জীবন ও ইতিহাস থেকে নতুন প্রজন্মের বিপ্লবীদের অনেক কিছু শেখার রয়েছে। একদিকে তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ বিপ্লবী, ত্যাগী, সাহসী ও অধ্যবসায়ী। এদেশের মাওবাদী আন্দোলনের ইতিহাসে তিনি ছিলেন অন্যতম প্রধান এক সামরিক-প্রতিভা। কিন্তু মতাদর্শগত-রাজনৈতিক দুর্বলতা ও বিচ্যুতির কারণে মাওবাদী গণযুদ্ধকে তিনি সার্বিকভাবে ধারণ করতে ব্যর্থ হন। তাঁর সামরিক প্রতিভারও ব্যাপক অপচয় তিনি করেন ব্যক্তি-বীরত্ববাদ, আত্মতৃপ্তি, মতাদর্শ-রাজনীতিকে প্রাধান্য না দেয়া প্রভৃতি মতাদর্শগত ত্রুটির গভীরে প্রবেশ করার মাধ্যমে; সর্বোপরি মালেমা’র চর্চাকে ভিত্তি না করার কারণে। এভাবে তিনি ব্যাপকভাবে সমরবাদ, ব্যক্তিতাবাদ, সংকীর্ণ অভিজ্ঞতাবাদ, একতরফাবাদ ও সংকীর্ণতাবাদী বিভেদপন্থা অনুশীলন করেন এবং মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাওবাদ (মালেমা) থেকে অনেকাংশে বিচ্যুত হন।

সুতরাং কম.মতিনের লাইন ও অনুশীলনকে খুবই গভীরভাবে ও বিশ্লেষণাত্মকভাবে বিচার করতে হবে। তিনি মাওবাদী আন্দোলন ও বিপ্লবকে আরো বেশি কিছু দেবার যোগ্যতা রাখতেন বললে ভুল হবেনা, যা তাঁর আত্মপর্যালোচনার অভাব, বিভেদাত্মক মনোভঙ্গি ও মালেমা থেকে বিচ্যুতি তাকে করতে দেয়নি।

আমরা তাঁর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করছি এবং সকল বিপ্লবাকাক্সক্ষী জনগণ এবং তরুণ প্রজন্মের বিপ্লবীদেরকে তাঁর অধ্যবসায়ী ত্যাগী ও সাহসী বিপ্লবী জীবন থেকে শেখার আহ্বান জানাচ্ছি; একইসাথে তাঁর গুরুতর দুর্বলতা ও বিচ্যুতিগুলো সম্পর্কে সতর্ক হতে আহ্বান জানাচ্ছি।

দপ্তর, সিসি, পূবাসপা।
তারিখ ঃ ১৮ আগস্ট, ২০১৯