করোনা ভাইরাস (কোভিড১৯) সংক্রান্ত – কেডারদের জন্য কিছু গাইড

২৫ এপ্রিল, ২০২০

ইতিমধ্যে বেশকিছু পত্রের মাধ্যমে বিভিন্ন ফ্রন্টে কর্মরত আমাদের নেতৃত্ব ও কেডারদের জন্য করোনা-সংশ্লিষ্ট অনেক বিষয়ে বেশ কিছু রাজনৈতিক মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়েছে। সেগুলো থেকে আমাদের বিভিন্ন স্তরের নেতৃত্ব ও কেডারদের পক্ষে পরিস্থিতিতে আমাদের করণীয়গুলো জানা সম্ভব। তথাপি এখানে খুব সংক্ষিপ্তভাবে কেডারদের করণীয়গুলোর কিছু জরুরি বিষয়ে পয়েন্ট আকারে তুলে ধরা হচ্ছে।

১। প্রথমত, আমাদের কেডারদের, বিশেষত সার্বক্ষণিক কর্মীদের কর্তব্য হলো পরিস্থিতির একটি বিজ্ঞানসম্মত ও বিপ্লবী মূল্যায়ন করতে পারা এবং তার ভিত্তিতে রাজনৈতিক কর্তব্যকে, সাংগঠনিক কর্তব্যকে পুনর্গঠিত করা এবং পাশাপাশি নিজেদেরকে রক্ষা করা।

২। নিজেদেরকে রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সতর্কতামূলক ব্যবস্থাদি যতটা সম্ভব গ্রহণ করা।

কিন্তু সেটা করতে গিয়ে শাসকশ্রেণি, রাষ্ট্র ও সরকারি, বা সাম্রাজ্যবাদী উপায়গুলোকে বিজ্ঞানের নামে মাথায় ঢুকিয়ে ফেললে চলবে না।

বিজ্ঞানকে মানুষ ব্যবহার করে নিজ নিজ শ্রেণি অনুযায়ী। উপরন্তু, যখন জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন সামনে আসে তখন বুর্জোয়ারা নিজেদের জীবন রক্ষাকেই সবচাইতে গুরুত্ব দেয়।

আমরা সেক্ষেত্রেও বিপ্লবী রাজনীতিকে, বিপ্লবকে, সাংগঠনিক স্বার্থকে, আত্মস্বার্থ বিসর্জনকে, আত্মত্যাগ ও আত্মবলিদানকে প্রাধান্য দেই।

৩। ত্রাণ সংক্রান্ত:

ত্রাণ-প্রশ্নে দু’ধরনের বিচ্যুতি দেখা যায়। বাম বিপ্লবের নামে ত্রাণ-প্রশ্নকে এড়িয়ে যাওয়া; ডান ত্রাণ কার্যক্রমকে সংস্কারবাদী ধারায় পরিচালিত করার চেতনা।

আমরা যেহেতু সাংগঠনিকভাবে অনেক জনগণের সাথে জড়িত, এবং তাদের মাঝে অধিকাংশই দরিদ্র, তাই তাদের সুখে-দুঃখে তাদের পাশে দাড়ানোর প্রশ্ন আমরা এড়িয়ে যেতে পারি না। যদিও এটা পরিষ্কার যে, ত্রাণ দেয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের, এবং তারাই প্রকৃতভাবে ত্রাণ দিতে সক্ষম আর্থিক-বৈষয়িকভাবে ও সাংগঠনিক ভাবে। এবং আমাদের সংগঠন ছোট ও গোপন-বিপ্লবী; তাই তার মাধ্যমে এবং এই বিশেষ ধরনের বিপর্যয়ে তেমন বেশি কিছু আমাদের করাও সম্ভব নয়।

তাই, আমাদের মূল দায়িত্ব হলো, ত্রাণ প্রশ্নে সরকারি দুর্নীতি, ব্যর্থতা, বাগাড়ম্বরপূর্ণ মিথ্যা প্রচারকে উন্মোচন করা, এসবের ভিত্তিতে জনগণকে আন্দোলন গড়ে তুলতে আহ্বান জানানো, যেখানে তারা নিজেরাই সেটা করছেন সেসবে অংশ নেয়া ও সঠিক রাজনৈতিক অবস্থানগুলো সেখানে তুলে ধরা, জনগণকে এসব প্রশ্নে সচেতন করা।

ত্রাণের ক্ষেত্রে এখন জনগণের নিকট থেকে সহায়তা সংগ্রহ করাটাও প্রায় সম্ভব নয়। তাই, আমাদের নিজস্ব ও সংশ্লিষ্ট ধনী ও মানবতাবাদী ব্যক্তিদের থেকে যতটা সম্ভব সংগ্রহ করা, সেগুলো প্রধানত আমাদের নির্দিষ্ট এলাকায় আমাদের নিজেদের দরিদ্র চাহিদাসম্পন্ন বিপন্ন মানুষ ও সংশ্লিষ্টদের মাঝে বিতরণ করা।

এগুলো বিতরণের সময়ও ত্রাণ প্রশ্নে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে বারংবার জনগণের মাঝে তুলে ধরা, বিশেষত আমাদের নিজস্ব লোকদেরকে সেবিষয়ে সচেতন করা।

৪। বাম ও সরকারবিরোধীদের রাজনৈতিক উদ্যোগের বিষয়ে:

আগেই বামদের উদ্যোগ সম্পর্কে ও শাসকশ্রেণির অন্যান্য শক্তিগুলোর ভূমিকা সম্পর্কে আমাদের কেডাররা জানেন। তবে এ বিষয়ে প্রতিনিয়ত বিকাশমান ঘটনা ও পরিস্থিতিগুলো সম্পর্কে যে যেখানেই থাকুন না কেন, খোঁজ রাখতে হবে।

বামরা একটি ‘সর্বদলীয় পরামর্শক সভা’র আয়োজন করেছিল, যার ঘোষিত লক্ষ ছিল একটি ‘সমন্বিত জাতীয় উদ্যোগ’ গ্রহণ। এতে আওয়ামী-জোট ও বিএনপি-জোট (জামাত ও অন্যান্য ধর্মবাদী শক্তিগুলো বাদে)সহ সকল প্রকাশ্য বাম-সংগঠনকেই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।

শাসকশ্রেণি, বিশেষত ফ্যাসিবাদী সরকারসহ, এ ধরনের উদ্যোগকে আমরা বিরোধিতা করি। কারণ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ যতই অপ্রতিরোধ্য হোক না কেন, তার কারণে জনগণের চলমান দুর্ভোগের ব্যাপকতা ও তাদের জীবনের অনিশ্চয়তা অনিবার্য নয়। তদুপরি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠাও সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার কর্মসূচি-কর্মকান্ডের প্রতিক্রিয়ার সাথে যুক্ত, যার অংশী হলো আমাদেরও শাসকশ্রেণি, রাষ্ট্র ও সরকার। এমনকি, এবারের দুর্যোগ আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্বের থেকে উদ্ভূত তাদের ষড়যন্ত্রের ফলও হতে পারে, যা ইতিমধ্যেই আলোচিত হচ্ছে।

দ্বিতীয়ত, তাদেরসহ কোনো ‘জাতীয় ত্রাণ কমিটি’ও কোনো কাজের নয়, কারণ, সেটা কার্যত হাসিনার পকেটেই থাকতে বাধ্য, বরং তাদের দুর্নীতির ভাগ অন্যদের ঘাড়েও পড়বে। সে দায়িত্ব কোনো আন্তরিক বাম-শক্তির নেয়াটাই একটা বুদ্ধুগিরি কাজ।

তৃতীয়ত, ত্রাণ-দুর্নীতি ও ব্যর্থতা বিষয়ে জনগণ ইতিমধ্যেই বিক্ষোভ করছেন, যাকে আওয়ামী নেতারা সুস্পষ্টভাবে ‘বিএনপি-জামাতে’র ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করেছে। তারা লজ্জাহীনের মতো দাবি করছে যে, হাসিনার যোগ্য নেতৃত্বে যথাযথ প্রস্তুতি থাকার কারণে করোনা সেভাবে আক্রমণ করতে পারেনি। ত্রাণ সবাই পাচ্ছে এবং কোনো বিক্ষোভ এখন হওয়ার কোনো প্রশ্ন আসে না।

যাহোক, ‘বাম’দের ‘জাতীয়’ উদ্যোগটি একটি অশ্বডিম্ব প্রসব করেছে। আওয়ামীরা যোগ দেয়নি। শেষ-পর্যন্ত তারা সরকারের কাছে দাবি করেছে ‘জাতীয় দুর্যোগ’ ঘোষণার। মূর্ত নির্দিষ্ট কর্তব্য ব্যতীত এ ধরনের বক্তব্য জনগণকে কোনো সঠিক দিশা দিতে পারে না। এটা জনগণকে আন্দোলনের পথ থেকে বিচ্যুত করে শাসকশ্রেণির পকেটে ঢোকানোর প্রচেষ্টা ছাড়া কিছু নয়।

পরে বিএনপি একটি ‘জাতীয় টাস্ক ফোর্স’ গঠনের আহ্বান করেছে। এর প্রতিক্রিয়ায় ওকা প্রশ্ন তুলেছে, এটা-কি পরে ‘জাতীয় কমিটি’ গঠন, এবং আরও পরে ‘জাতীয় সরকার’ গঠনের দাবির দিকে চালিত হবে?

এক্ষেত্রে ভোট-বিহীন ক্ষমতা কুক্ষিগতকারী আওয়ামীদের ভয় প্রকাশ পেয়ে যাচ্ছে। একইসাথে বিএনপি, রব-জাসদ, মান্না-সুশীল, তৃতীয় শক্তির এনজিও-দের সম্ভাব্য রাজনীতিকেও ইঙ্গিত দেয়। কারণ, ইতিমধ্যেই সেনাবাহিনী মাঠে রয়েছে। তাদের মতি-গতি শাসকরা অনেকটা অবগত। তারা ভবিষ্যতে কী করবে, কী চাইবে, বা শাসকশ্রেণি নিজেদের সংকট মোচনের জন্য তাদেরকে কীভাবে দেখতে চায় তার উপর অনেককিছু নির্ভর করবে।

তারা উৎপাদন নিয়ে শংকিত। সরকার আগামী অর্থনৈতিক সংকট নিয়ে বিপদে রয়েছে। এর সুযোগ প্রত্যেকেই নিতে চাইবে। ধর্মবাদীরা ইতিমধ্যেই খুব শক্তিশালী প্রতিপক্ষ, জনগণের তো বটেই, প্রচলিত বুর্জোয়া রাজনীতিরও হয়তো।

আমাদেরকে অবশ্যই শাসকশ্রেণির এসব রাজনীতিকে বিরোধিতা করতে হবে, এবং সকল প্রশ্নে শাসকশ্রেণি বহির্ভূত জন-আন্দোলনকে শক্তিশালী করার দিকেই গুরুত্ব দিতে হবে। তার ভারকেন্দ্র হলো আমাদের নিজস্ব পার্টি-গত শক্তি, দুই হলো, আমাদের রাজনৈতিক দিক-নির্দেশনায় সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, শাসকশ্রেণি বিরোধী, রাষ্ট্রযন্ত্র বিরোধী শক্তিগুলোর জোটবদ্ধতা।

৫। বিশ্ব-রাজনীতি:

একদিকে গর্বাচেভ, গুতেরেস, অমর্ত্য সেনসহ বুর্জোয়া মানবতাবাদী-সংস্কারবাদীরা সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থা অক্ষুণ্ন রেখে তার ঐক্যের ও সংস্কারের বার্তা তুলে ধরছে। তারা বলছে, বিশ্ব-ব্যবস্থা বদলে যাবে, কিন্তু কী ধরনের ব্যবস্থা আসবে?

কিন্তু তারা আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্বকে লুকিয়ে রাখতে চাচ্ছে। অথবা মনে করছে, তাদের সদিচ্ছার কারণে সেটা ফেটে পড়বে না। ইতিমধ্যেই আমেরিকা-ট্রাম্পের বিশ্ব-স্বাস্থ্যসংস্থার অর্থ প্রত্যাহার করা, চীনের বিরুদ্ধে গায়ে পড়ে ঝগড়া, রাশিয়া-চীনের এমনকি জার্মান-ফ্রান্সের পর্যন্ত মার্কিন-বিরোধী কথাবার্তা আগামী বিশ্বে মার্কিনের নেতৃত্বাধীন এক-মেরু বিশ্বের আরো ভাঙ্গন ও বহু-মেরু বিশ্বের ইঙ্গিত করছে, যা কিনা আরো অস্ত্রসজ্জা, আরো যুদ্ধ, এমনকি বিশ্ব-যুদ্ধের দিকে বিশ্বকে চালিত করতে পারে। যা সমগ্র বিশ্বকেই এক নতুন টারময়েলে ফেলবে।

করোনা পরবর্তীতে যে গুরুতর অর্থনৈতিক সংকট বিশ্ব-সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থা, ও তার অংশ হিসেবে আমাদের দেশে আসছে তার কোনো ভাল সমাধান এদের কাছে নেই।

এসবই একদিকে যুদ্ধ ও ফ্যাসিবাদের বিপদ বাড়াবে, অন্যদিকে জন-আন্দোলন ও বিপ্লবের শক্তিশালী হবার সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে তুলবে।

আমাদের কেডারদেরকে এ বিষয়গুলোতে খুবই সচেতন থেকে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কাজ করতে হবে।

সতর্ক হোন, নিজেদের নিরাপত্তাকে জোরদান করুন, প্রচলিত কর্মপদ্ধতিকে পুনর্গঠিত করুন, পরিস্থিতির সুযোগ নেবার জণ্য সর্বদা প্রস্তুত থাকুন।

৬। আমাদের কর্তব্য বিষয়ে সচেতন থাকা:

… … …

… … …

… … …

পার্টিকে পুনর্গঠিত করাও প্রয়োজন। যারা জনগণ ও বিশ্বের সংকটের চেয়ে বড় গুরুত্ব দেয় নিজেদের কাইজ্যা-ফ্যাসাদকে, নিজেদের প্রেম-পরিবারকে, নিজেদের সুস্থতার স্বার্থকে, বেঁচে থাকার জন্য ভয়ে সিঁটকে থাকে, তাদের থেকে পার্টির গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোকে মুক্ত করে ফেলতে হবে। ঝাড়াই-বাছাই করতে হবে।

নতুন উপাদান পার্টিতে আনতে হবে, যারা বিপ্লবে ঝাঁপিয়ে পড়তে, সর্বস্ব ত্যাগ করতে ইচ্ছুক, শ্রমিক-কৃষকের পাশে দাঁড়াতে ইচ্ছুক সেসব তরুণ-বুদ্ধিজীবীদেরকে। জন-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মূল জনগণের সমর্থনে পার্টিকে পরিপুষ্ট করা ও তাদের থেকে নতুন উপাদান টেনে আনায় জোর দিতে হবে।

যারা দৃষ্টিভঙ্গিগতভাবে বুর্জোয়া সংস্কারবাদী চেতনায় বারবারই নিমজ্জিত হয়, যারা প্রাকৃতিক সংকটের সমাধানে শ্রেণি-দৃষ্টিভঙ্গি হারিয়ে ফেলে তাদের হয় সংশোধিত করতে হবে, নতুবা গুরুত্ব কমিয়ে দিতে হবে।

………

…….

** নিশ্চয়ই এ পরিস্থিতি এরকমই থাকবে না। বুর্জোয়ারাই বলছে বিশ্ব বদলে যাবে। শুধু হাসিনাই বলছে না, কারণ, বদলে যাওয়া মানে তার বিদায়। বদলে যাওয়া মানে জনগণের শক্তি বেড়ে যাওয়া। কিন্তু রাজনৈতিক ভাবে পথ দেখানোর দায়িত্ব আমাদের। তাহলে বহু বামশক্তি, যারা আজ ভুল পথে চালিত হচ্ছে, তারা অন্য পথ দেখবে, আমরা প্রচুর মিত্র পাবো, যা দিয়ে আমরা নিজেদের শক্তিকেও বাড়িয়ে নিতে পারবো, আমাদের সংকট ও দুর্বলতাগুলোকে কাটিয়ে তুলতে পারবো।

বিপ্লব ও পার্টি সম্পর্কে, বিশ্ব ও মানুষের ভবিষ্যত সম্পর্কে আশাবাদী হোন; লক্ষ্য অর্জনে কঠোর প্রচেষ্টা চালান।

কেন্দ্রীয় কমিটি
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি