করোনা ভাইরাস (কোভিড১৯) সংক্রান্ত – পরিস্থিতি সম্পর্কে

১২ এপ্রিল, ২০২০

লকডাউন ও করোনা বিস্তার

১। প্রধানমন্ত্রী ২৫ তারিখে ভাষণ দেয়ার আগেই সেনাবাহিনী নামানো হয়। কার্যত লকডাউনও ঘোষণা করা হয়। পরিবহন বন্ধ করে দেয়া হয়। সরকারি-বেসরকারি অফিস আদালত বন্ধ করা হয়। কার্যত জনগণের জীবনে কারফিউ পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়।

প্রথমে এ ‘ছুটি’ দেয়া হয় ৪ এপ্রিল পর্যন্ত। তারপর তাকে বাড়িয়ে করা হয় ৯ এপ্রিল পর্যন্ত। পরে তাকে বাড়িয়ে দেয়া হয় ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত। এবং এবার একটু বুদ্ধি করে ১৪ এপ্রিল আসার আগেই বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত।

কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে তাকে লকডাউন না বলে বলা হচ্ছে “ছুটি”, “বন্ধ” ইত্যাদি।

যদিও প্রধানমন্ত্রী বলে দিয়েছেন, যেখানে করোনা আক্রান্ত পাওয়া যাবে সেগুলোকে ‘লক ডাউন’ ঘোষণা করা হবে। এ পর্যন্ত অনেকগুলো জেলা বা উপজেলাকে লকডাউন করা হয়েছে। তবে বিষয়টা প্রায় একই থাকছে। মানুষজন বাজারে যাচ্ছেন, ত্রাণের জন্য ভিড় করছেন, গোপনে মানুষজনও চলছেন গাড়ি বা ট্রলারে, গলিগালায় আড্ডা চলছে। মানুষ কী করবেন?

অবশ্য কিছু কিছু বাড়ি, রাস্তা বা এলাকায় এক ধরনের লক ডাউন চলছে।

প্রশ্ন হলো, আমাদের মত দেশে পশ্চিমা দেশের মত লক ডাউন কার্যকর কিনা। আবার ‘সামাজিক বিচ্ছিন্নতা’রও প্রয়োজন রয়েছে। বুর্জোয়া বা শিক্ষিত মধ্যবিত্তের সেটা ভাবার মাথা নেই। এখানে যেটা সম্ভব ও প্রয়োজনীয় তা করা, বিশেষত ব্যাপক সাধারণ মানুষের উপযোগী, শাসকশ্রেণির পক্ষে সম্ভব নয়।

২। সরকার জনগণকে ঘরবন্দি করলেও গার্মেন্টগুলো বন্ধ করার সিদ্ধান্ত প্রথমে নেয়নি। মূলত তাকে চালু রাখার চেষ্টাই করেছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নিজে তার দায়িত্ব না নিয়ে গার্মেন্ট-মালিকদের উপর সিদ্ধান্তটা চাপিয়ে দেয়ার সুবিধাবাদী পথ নেন। আসলে তাদের এ সুবিধাবাদী সিদ্ধান্তের কারণেই “বন্ধ” পরিস্থিতিতে গার্মেন্ট-শ্রমিকসহ লক্ষ লক্ষ মানুষ কী করবেন তাতে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগেন। একটা বড় অংশ কোনো রকম সরকারি “সামাজিক বিচ্ছিন্নতা”র নির্দেশের তোয়াক্কা না করে ২৫ মার্চের আগে-পরে গ্রামে চলে যান।

এভাবে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের কারণে দ্বিতীয়বারের মতো করোনা-কে দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি সৃষ্টি করা হয়। প্রথমবার সেটা হয়েছিল বিদেশ-ফেরত প্রায় ৬/৯ লক্ষ প্রবাসীদেরকে কোয়ারেন্টাইনে না রেখেই সারা দেশে ছড়িয়ে পড়তে দিয়ে। সেটাও প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তেই হয়েছিলো।

গুরুতর সিদ্ধান্তহীনতার কারণে গ্রামমুখী জনগণ ৪/৫ এপ্রিল পুনরায় ঢাকামুখী হন। যাতে ৩য় বারের মত করোনা ছড়িয়ে দেয়ার ঝুঁকি সৃষ্টি করা হয়। এটাও হয় প্রধানমন্ত্রীর সুবিধাবাদী সিদ্ধান্তের কারণেই। কিন্তু এজন্য তাকে দায়ী না করে আওয়ামী বুদ্ধিজীবীরা মৃদুস্বরে গার্মেন্ট মালিকদেরকে দোষারোপ করে, এমনকি ‘মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্ম’ নামের একটি ভুঁইফোড় সংগঠন এজন্য গার্মেন্ট মালিকদের নেতা রুবাবা হকের শাস্তি দাবি করে। নিশ্চয়ই তারাও দায়ী, কিন্তু তাদেরই সরকার-প্রধান যে সেজন্য প্রধান দায়ী সেটা গোপন করার চেষ্টা করা হয়।

৩। উপরন্তু, গ্রামে যাওয়া ও আসার পথে জনগণকে ২০০ টাকার ভাড়া ১ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ করতে হয়, তথাকথিত পরিবহন চলাচলের ক্ষেত্রে সঠিক নিয়ন্ত্রণ ও সঠিক ব্যবস্থাপনার বদলে সেটা ‘বন্ধে’র কাদের-মার্কা গণবিরোধী সিদ্ধান্তের কারণে। শুধু তাই নয়, অর্থ অপচয় ছাড়াও পথিমধ্যে পরিবহন অভাবে জনগণকে অবর্ণনীয় দুর্গতির মধ্যে পড়তে হয়। হাজার হাজার নারী-পুরুষ , এমনকি সন্তান কোলে পর্যন্ত হেঁটে, রিক্সায় যে যেভাবে পেরেছেন শহরে গিয়ে জানতে পারেন যে, গার্মেন্ট ১১ তারিখ পর্যন্ত (পরে আবার ১৪ তারিখ পর্যন্ত) বন্ধ থাকবে।

৪। করোনা বিস্তারের হাত থেকে শহরের বস্তিবাসীদেরকে রক্ষা করার কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। নগরের দরিদ্র এলাকার লক্ষ লক্ষ ভাড়াটিয়া শ্রমজীবী মানুষকে রক্ষার কোনো ব্যবস্থাও প্রকৃতপক্ষে করা হয়নি।

৫। এ পর্যন্ত ২৫ তারিখে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ ছাড়াও প্রধানমন্ত্রী একবার সাংবাদিক সম্মেলনের নামে একতরফা ভিডিও-ভাষণ এবং জেলা-ভিত্তিক আমলাদের সাথে দুটো ভিডিও কনফারেন্স করেছেন। করোনা প্রতিরোধ ও চিকিৎসার ক্ষেত্রে জনগণের উদ্দেশ্যে শুধু ঘরে থাকার নির্দেশ ব্যতীত আর কোনো সত্যিকার পদক্ষেপের ঘোষণা দেননি। আবার তিনি একে যুদ্ধের সাথে তুলনা করেছেন। সবাই ঘরে থাকলে যুদ্ধটা কে করবে? কীভাবে করবে? যুদ্ধের সৈনিক কারা? তারা কে কী করবেন? এ ধরনের গণযুদ্ধে স্বেচ্ছাসেবী কোথায়? প্রস্তুতি কী?

এভাবে এই গণবিচ্ছিন্ন, গণবিরোধী ও শ্রমিক-শ্রমজীবী জনগণের শত্রু সরকার ও প্রধানমন্ত্রী জনগণের জীবন-জীবিকা নিয়ে ছিনিমিনি খেলা করেছে।

করোনা প্রতিরোধ ও চিকিৎসা

১। সরকার এলোপাথাড়ী ও উপস্থিতমতো সব পদক্ষেপ নিচ্ছে, যা এসেছে প্রধানত তাদের প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থানের কারণে; দ্বিতীয়ত তাদের গুরুতর ব্যর্থতা, ব্যক্তি নির্ভরতা, ব্যক্তি তোষামোদী থেকে (প্রধানমন্ত্রীর)। এতে কোনো দূরদর্শী চিন্তা বা পরিকল্পনার কোনো লক্ষণ দেখা যায় না।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা পর্যন্ত বার বার বলেছে শুধু বিচ্ছিন্নতা দিয়ে করোনা প্রতিরোধ করা যাবেনা। তার সাথে যুক্ত করতে হবে পরীক্ষা।

আমেরিকায় ট্রাম্পের মত একটি বদ সরকারের শাসিত দেশে পর্যন্ত প্রতিদিন ১ লক্ষ পরীক্ষা হচ্ছে। কোনো কোনো দেশে সমস্ত জনগোষ্ঠীকে পরীক্ষার আওতায় আনা হয়েছে। কিন্তু দেশে সুদীর্ঘদিন ধরে শুধু একটি মাত্র কেন্দ্রে অল্প কিছু পরীক্ষা করা হয়েছে প্রথম ১৭ দিনে মাত্র ১,৫০০ মতো। পরীক্ষা-কীট ছিল মাত্র ২ হাজারের মতো।

ব্যাপক সমালোচনার মুখে তারা কীট সংগ্রহ, পরীক্ষা কিছু বাড়ালেও সেটা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগণ্য। একদিন প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছিলেন দিনে প্রতি উপজেলায় কমপক্ষে দু’জন করে পরীক্ষার, পরপরই সে নির্দেশ তুলে নেয়া হয়েছে। স্বয়ং স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে এ বিষয়ে কোনো কিছু জানানো হয়নি, যিনি কিনা করোনা ‘জাতীয় কমিটি’র প্রধান! সবকিছু যদি প্রধানমন্ত্রীই মনিটর করেন তাহলে স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে বেহুদা প্রধান কেন করা হলো?

২। স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষার এতটা খারাপ পরিস্থিতি ছিল যে, তারা পর্যন্ত জ্বরের রোগী শুনলেই পিছিয়ে গেছেন।

হাসপাতালগুলোতে করোনা দূরের কথা, সাধারণ চিকিৎসা পর্যন্ত বন্ধ হবার পথে চলেছে।

এখন পরীক্ষার কীট, কেন্দ্র, সুরক্ষা সামগ্রী, পৃথক হাসপাতাল বা বেড ইত্যাদি বাড়ানো হলেও জনগণের জন্য এখনো কোনো ভাল দূরের কথা, স্বস্তিকর পরিস্থিতিও সৃষ্টি হয়নি।

কীট, স্বাস্থ্যকর্মীদের বিকল্প হিসেবে রোবট ইত্যাদিতে দেশের বৈজ্ঞানিকগণ বেশ কিছু উদ্ভাবণ করলেও সেগুলো প্রমোট করা হয়নি। অর্থ সাহায্য করা হয়নি। সব কিছুর জন্য বিদেশের উপর নির্ভর করে চলেছে।

মিডিয়ার খবরে জানা যায়, বর্তমানে দৈনিক ৫ হাজার পরীক্ষার সামর্থ্য থাকলেও দিনে গড়ে এক হাজার মাত্র পরীক্ষা করা হচ্ছে।

অনেকেই সন্দেহ করছেন, এটা করা হচ্ছে আক্রান্তের সংখ্যা কমিয়ে দেখানোর জন্য, যাকিনা করোনা ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ। আক্রান্ত ও মৃত্যুর এ কম সংখ্যাকে প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের কৃতিত্ব হিসেবে বর্ণনাও করা হয়েছে।

৩। চিকিৎসা ব্যবস্থার অতিভঙ্গুর দশা এবং জরুরি এ অবস্থায় সঠিক প্রস্তুতি ও পদক্ষেপে সরকারি ব্যর্থতাকে আড়াল করার জন্য তারা চিকিৎসা-কর্মীদের দায়ী করার কৌশল নিয়েছে। ইতিমধ্যে তারা ৬ জন ডাক্তারকে বরখাস্ত করেছে।

এটা সত্য যে, বিশেষত ডাক্তার ও হাসপাতালগুলোতে জনস্বাস্থ্য ও জনসেবার মনোভাব খুবই কম, যার জন্য শাসকশ্রেণি, বিশেষত হাসিনা সরকারের স্বাস্থ্যনীতি দায়ী। প্রায় সমস্ত চিকিৎসা-ব্যবস্থাকে ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দিয়ে বিরাষ্ট্রীকরণ করা হয়েছে। তারা প্রায় সবাই মুনাফা তৈরিতে ব্যস্ত, অনেকে হাসিনার দালালীতে সক্রিয় এবং ফলত তারা ব্যক্তি স্বার্থপরায়ণ, ভীরু ও দায়িত্বহীন।

দেশের স্বাস্থ্য-খাতে বরাদ্দ খুবই অপ্রতুল, যা বর্তমানে দগদগে ঘা-এর মত দেখা দিয়েছে।

তদুপরি চিকিৎসা-কর্মীদের যতটুকু সুরক্ষা প্রয়োজন ছিল সেটার প্রস্তুতি নিতে ও ব্যবস্থা করতে সরকার নিদারুণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। তাদের পক্ষ থেকে ভয়, দায়িত্ব পালনে অনীহা, জনগণ বিশেষত মূল জনগণের প্রতি নির্মমতা এ ধরনের সমাজে অস্বাভাবিক কিছু নয়।

চিকিৎসা-কর্মীদেরকে তাদের পরিবার ও লোকালয় থেকে বিচ্ছিন্ন করে এই জরুরি অবস্থায় থাকা, খাওয়া ও পরিবহনের পৃথক কোনো ব্যবস্থাটুকু পর্যন্ত করা হয়নি। প্রথমদিকে তাদের চলতি সুরক্ষা সামগ্রী পর্যন্ত ছিল না বললেই চলে। তাই, ভাল কোনো অনুসন্ধান না করে, জবাবদিহিতার সুযোগ না দিয়ে, স্বেচ্ছামূলক ভাবে তাদেরকে কাজে উদ্বুদ্ধ করার পরিবর্তে বরখাস্ত করার মধ্য দিয়ে সামরিক শাসকদের সমস্যা সমাধানের পদ্ধতিটি প্রকাশিত হচ্ছে, যা পরিস্থিতিকে শুধু আরো খারাপের দিকেই নিয়ে যেতে পারে।

৪। ক্রমে ক্রমে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন ব্যক্তি উদ্যোগে ত্রাণ বা চিকিৎসা কার্যক্রম চলছে, তার জন্য অনেকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন।

কিন্তু এ সমস্ত উদ্যোগকে সমন্বিত করা, জনগণকে তাতে সামিল করার কোনো ব্যবস্থাই করা হয়নি। একদিকে সবকিছু আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনার হাতে রাখার মাধ্যমে জনগণের উদ্যোগ সমন্বিত করা ও জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করাকে বাধাগ্রস্থ করা হচ্ছে। অন্যদিকে আর্মি নামালেও অজানা ভয়ে তাদের হাতেও অনেককিছু ছেড়ে দেয়া হয়নি বা তাদের সামর্থকে কাজে লাগানো হয়নি।

লকডাউন ও জনগণের হয়রানি

১। লকডাউন পরিস্থিতিতে জনগণের সচেতনতার উপর নির্ভর করে তাদের শক্তিকে ভিত্তি না করে পুলিশ-আওয়ামী মাস্তান দিয়ে তাদের উপর অহেতুক হয়রানি নামিয়ে আনা হয়।

নগর/শহরবাসী লক্ষ লক্ষ শ্রমজীবী ও দরিদ্র মানুষের কাজ-কাম বন্ধ, তারা অধিকাংশই একটি ঘরে অনেকে একত্রে থাকেন, যেসব ঘর প্রায়ই বস্তিসদৃশ বা বস্তি। যেখানে আলো-বাতাস চলে না, বিশুদ্ধ পানির ও টয়লেটের সুব্যবস্থা নেই, ঘরে কোনো বিনোদনের ব্যবস্থা নেই। একেকটি ভবনে ৫/১০/২০টা করে এ ধরনের ঘর। এতে কয়েক ঘন্টা জেগে বসবাস করা সুস্থ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। দরিদ্র জনগণের এই বাস্তবতাকে আমলে না নিয়ে আমলাতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত দ্বারা তা কার্যকরের ব্যর্থ চেষ্টা সরকার ও রাষ্ট্র করেছে।

এমন অবস্থায় এই জনগণ অনেকে বাধ্য হয়ে রাস্তায় নেমে পুলিশের-আওয়ামী মাস্তানদের হয়রানি/অপমান/শারীরিক নির্যাতনের মুখে পড়েছেন।

২। সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয়েছিল ঔষধের দোকান, মুদি দোকান, কাঁচাবাজার খোলা থাকবে। স্বভাবতই মানুষকে ঘরের বাইরে যেতে হবে। সেক্ষেত্রে কোনো রকম নীতিমালা না করে প্রথমদিকে পাইকারি সমস্ত লোককে বাইরে গেলেই হয়রানি করা হয়েছে। অন্যদিকে গ্রামাঞ্চলে “সামাজিক বিচ্ছিন্নতা” পালিত হয়নি। এমনকি নগর/শহরেও কাঁচাবাজারগুলোতে কোনো রকম নিয়ম-নীতি করা হয়নি। ভীড় চলছেই। এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে সরকার/রাষ্ট্র যে সম্পূর্ণ ব্যর্থ, এবং দেশের সামাজিক অবস্থায় যে তা জনগণের জন্য প্রায় কেতাবী সেটা বারবার প্রমাণিত হয়েছে।

শুধু তাই নয়, ত্রাণ দেয়া, ১০টাকা কেজি চাল দেয়া ইত্যাদি কাজে ব্যাপকভাবে জনসমাগম করে তারা নিজেরাই নিজেদের ঘোষিত নিয়ম লংঘন করেছে। আওয়ামী মাস্তানরা কোনো কোনো জায়গায় জনগণকে নিয়ম মানানোর জন্য একত্রে মোটর-সাইকেলে চড়ে ১০/১৫ জন একত্র হয়ে নিজেরাই নিয়ম ভেঙ্গেছে।

লকডাউন এবং কৃষি ও ক্ষুদে উৎপাদন

১। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণগুলোতে এ পর্যন্ত কৃষক, কৃষি উৎপাদন, কৃষিভিত্তিক ডেইরি, পোলট্রি, মৎস্য ইত্যাদির প্রশ্নে নির্দিষ্টভাবে কোনো মূর্ত দিক-নির্দেশনা দেয়া হয়নি।

পচনশীল কৃষি-দ্রব্যাদি যেমন, দুধ , ডিম, মৎস্য বা সব্জি এগুলোর উৎপাদন রক্ষা করার জন্য ভর্তুকি, পদক্ষেপ, বিপননের জন্য করণীয় এগুলো কিছুই করা হয়নি।

খাবার দোকান খোলা রাখার কথা বলা হলেও সেগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, তার সাথে মিষ্টির দোকানগুলোও বন্ধ রাখা হয়েছে। ফলে প্রতিদিন প্রায় ১/দেড় কোটি লিটার দুধের বিপননের কোনো সু-ব্যবস্থাই করা হয়নি।

২। এবারের সংকট প্রমাণ করেছে যে, বিদেশ-নির্ভর শিল্প ও অর্থনীতির উন্নয়ন কীভাবে যেকোনো বিশ্ব-সংকটে দেশ ও জাতিকে কীভাবে চরম সংকটে ফেলে দেয়।

এত উন্নয়নের গলাবাজীর পর মাত্র ১৫ দিন না যেতেই দেশ দরিদ্র হয়ে গেছে।

অর্থের অভাব মোচনের জন্য শাসকশ্রেণিকে আঘাত করে এমন কোনো পদক্ষেপই তারা নেয়নি। বড় বড় ‘উন্নয়ন প্রকল্প’-কে বন্ধ করে সেই টাকা দিয়ে মানুষকে বাঁচানোর বিভিন্ন আবেদন সত্তে¡ও তাতে কর্ণপাত করছে না। তারা দুর্নীতিবাজদের অর্থ বাজেয়াপ্ত করছে না। তারা ঋণখেলাফীদের জরিমানা করছে না। আরো বহু উপায়কে তারা আমলে নিচ্ছে না। মানুষেকে বাঁচানো ও জরুরি কৃষি উৎপাদন ও কুটির-ক্ষুদ্র শিল্প রক্ষায় তারা অর্থ ব্যয় না করে একই ধারায় চলছে।

তথাপি তারা সাম্রাজ্যবাদী ও তাদের দালাল বড় ধনীদের স্বার্থের বাইরে কিছুই করছে না। দেশকে রক্ষার জন্য যখন কৃষিকে ভিত্তি করে, কৃষিভিত্তিক কুটির ও ক্ষুদে উদ্যোক্তাদেরকে রক্ষা করে এবং ক্ষুদে শিল্পকে রক্ষা করার নীতি অপরিহার্য সেখানে তারা তাদের জন্যই কিছু করেনি। এটা তাদের বিদেশ-নির্ভর দালালী চরিত্রকে পুনরায় প্রমাণ করছে।

এদের উন্নয়ন যে প্রকৃত কোনো উন্নয়ন নয়, সেটা ইতিমধ্যেই প্রমাণ হয়েছে; আগামীতে আরো প্রমাণিত হবে।

ত্রাণ বিতরণ

একটা হযবরল অবস্থা চলেছে।

১। মেম্বার/কমিশনাররা সর্বত্র ত্রাণ দিচ্ছে না। বলছে, তারা পায়নি। অনেকে পেয়েও দুর্নীতি করছে।

এতে প্রমাণ হয় যে, হয় তারা দুর্নীতি করে সেগুলো লুট করছে, যার কিছু কিছু খবর কয়েকদিন ধরে মিডিয়াতে প্রকাশ হয়ে পড়ছে। নতুবা প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ঘোষণা অনেকটাই দায়সারা।

২। অনেকক্ষেত্রে শহরের আওয়ামী বাড়ীওয়ালারা ত্রাণসামগ্রী এনে নিজেরাই খেয়ে নিচ্ছে।

৩। অনেক নেতা ও সেলিব্রেটিরা নিজ উদ্যোগে যেখানে সেখানে যাকে তাকে ত্রাণ দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, তাদের অনেকে আবার সেগুলো ভিডিও প্রচার করে বাহবা নেয়ার মত অশ্লীল কাজ করছে।

এগুলো নিয়ন্ত্রণ বা সমন্বিত করার কোনো পদক্ষেপই দেখা যাচ্ছে না।

আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা

১। প্রধানমন্ত্রীর ২৫ তারিখের ভাষণে শুধু বিদেশ-নির্ভর বৃহৎ শিল্পের স্বার্থ বিষয়ে কিছু প্রণোদনার কথা ছিল যা অনুদানও নয়, ঋণ, যা সুদমুক্ত নয়। এমনকি সেটা কীভাবে খরচ হবে তারও কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়নি।

পরে সমালোচনার মুখে ঘোষণা করা হয় যে, ঘোষিত ৫ হাজার কোটি টাকা শুধু শিল্পগুলোর কর্মীদের বেতন বাবদ দেয়া হবে। কিন্তু বহু গার্মেন্ট কারখানায় সে বেতন এখনো পর্যন্ত দেয়া হয়নি। একজন মালিক বিবিসি’র সাথে বলেছে, সরকারের এই টাকা তারা এখনো পায়নি, পাবে ১০ মে তারিখে, তার আগে তাদের বেতন দেয়া সম্ভব নয়। শ্রমিকরা কীভাবে বাঁচবেন? শ্রমিকরা বেতন না পেয়ে এরকম কারফিউ পরিস্থিতিতেও বেশ কিছু জায়গায় রাস্তার আন্দোলনে বাধ্য হচ্ছেন।

কিছু পরে ৫ এপ্রিল তারিখে সাংবাদিক সম্মেলনে ৭৩ হাজার কোটি টাকার এক অনির্দিষ্ট প্রণোদনার নামে একটি ঋণ-প্যাকেজ ঘোষণা দেয়া হয়, যাতে বর্তমানের জরুরি সমস্যা স্বাস্থ্য-সংকট ও শ্রমজীবী-দরিদ্র মানুষের বেঁচে থাকার বিষয়ে কিছুই ছিল না; এমনকি দেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তি কৃষি এবং কুটির ও ক্ষুদ্র শিল্প রক্ষারও কোনো সুনির্দিষ্ট ঘোষণা ছিলনা।

পরে ব্যাপক সমালোচনার মুখে একবার চিকিৎসা-কর্মীদের বিষয়ে কিছু সম্মানী ঘোষণা করা হয়। পরে আবার কৃষি বিষয়ে কিছু প্রণোদনার কথা ঘোষণা করলেও সেগুলো আগের মতই ঋণ-প্যাকেজ মাত্র, তাও সুদমুক্ত নয়।

এমনকি যে রেমিটেন্সের উপর তারা অর্ধেক বেঁচে থাকে তার কারিগর প্রবাসীদের বিষয়েও এখনো পর্যন্ত কিছুই বলা হয়নি। দেশে ফিরে আসা বা বিদেশে আটকে পড়া প্রবাসীরা তাদের পেশা, চাকরি ও ভবিষ্যত নিয়ে কোনো দিক-নির্দেশনাই পাচ্ছেন না। তারা রয়েছেন চরম অনিশ্চয়তায়।

অথচ এ ধরনের গণবিরোধী ও দিক-নির্দেশনাবিহীন একটি ঋণ-প্যাকেজকেই সরকারি এক মন্ত্রী বলেছেন যুগান্তকারী, যা কিনা বিশ্বে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। এই মোসাহেব মন্ত্রী এও দাবি করেছেন যে, ভারতে জিডিপি’র যে অংশ ঘোষণা হয়েছে তার দ্বিগুণ শেখ হাসিনা দিয়েছেন এবং তিনি বিশ্বে অনন্য নজীর স্থাপন করেছেন।

ভারত, এমনকি পাকিস্তানের শাসক ও রাষ্ট্র বাংলাদেশের মতই গণবিরোধী হলেও তাদের ঘোষিত প্যাকেজ অনেক বেশি করে শ্রমজীবী ও দরিদ্র মানুষের বেঁচে থাকার কিছুটা উপযোগী, যা বাংলাদেশে নেই। ত্রাণ, কর্মহীন মানুষকে খাদ্য সরবরাহ ও তাদেরকে নগদ অর্থপ্রদান, অন্তত কয়েকটি মাস তাদেরকে রক্ষা করা, তাদের বাসাভাড়ার ক্ষেত্রে ব্যবস্থাদিসহ আরো বেশ কিছু বিষয়ই রয়েছে যা হাসিনার প্যাকেজে নেই। তবুও তিনি বিশ্বের নজীর স্থাপনে সক্ষম নেত্রী!

উপসংহার

আগামীতে পরিস্থিতি কোনদিকে এগোয় বলা খুব কঠিন।

প্রথমত, এটা নির্ভর করে করোনার বিস্তার কতটা ঘটে। দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক মন্দা বিশ্ব ও দেশীয় অর্থনীতিকে কতটা প্রভাবিত করে। তৃতীয়ত, এক্ষেত্রে সরকারি ব্যর্থতা, লুটপাট, দুর্নীত কতটা তাদের উপর জনগণকে ক্ষিপ্ত করে। চতুর্থত, শাসকশ্রেণির মধ্যকার কামড়াকামড়ি এ পর্যায়ে কোথায় গিয়ে পরিণতি পায়। পঞ্চমত, দেশীয় শাসকশ্রেণি ও বিশ্ব-সাম্রাজ্যবাদীরা রাজনৈতিকভাবে কোন পথে এগিয়ে যাবে। এ ধরনের অনেকগুলো বিষয়ের উপর।

জনগণকে অবশ্যই সংগঠিত হতে হবে নিজেদের দুর্ভোগ ও অনিশ্চয়তার প্রধান উৎস এই গণবিরোধী সরকার, শাসকশ্রেণি ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। তাদের প্রভু সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব-ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। এদের বিরুদ্ধে জনগণের, বিশেষত শ্রমিক, শহুরে দরিদ্র ও কৃষকের সংগ্রাম ও সঠিক কর্মসূচির অধীনে তার পরিচালনাই তাদের অসহায়ত্বকে কমিয়ে আনতে পারে, অন্যকিছু নয়। আর সেটা তাদেরকে মুক্তির পথেও নিয়ে যেতে পারে।

কেন্দ্রীয় কমিটি
পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি