আত্মসমর্পনের নাটক ও মাওবাদের ভূত

আত্মসমর্পনের নাটক ও মাওবাদের ভূত
——-সূর্য্য

গত ৯ এপ্রিল পাবনা সদরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে ৫৯৫ জন চরমপন্থী আত্মসমর্পন করেছে! দেশের প্রতিটি বাজারী খবরের কাগজ ও চ্যানেল সমূহ ফলাও করে এই খবর প্রচার করেছে।খবরের পাশাপাশি দু একজন “চরমপন্থীর” আত্ম উপলব্ধিও প্রচারিত হয়েছে।এই আত্ম উপলব্ধির মধ্যে রয়েছে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর গুনগান সহ নানান কথা! এতে দেশের অনেক “শান্তিপ্রিয়” বুদ্ধিজীবি খুশি হয়েছেন।কিছু বিপ্লব আকাঙ্খী মানুষও বিভ্রান্ত হয়েছেন।ব্যাপক সংখ্যক জনগন বিভ্রান্ত হয়ে ক্ষুব্ধ হয়েছেন সাময়িকভাবে। যেসব জনগনের উপর দাঁড়িয়ে বিপ্লবী পার্টি গুলো টিকে ছিলো তারা স্বাভাবিকভাবেই এমন একটি রাষ্ট্রীয় নাটকে বিভ্রান্ত হতেই পারেন।হয়েছেনও অনেকে।অসংখ্য জনগন বিভ্রান্ত হয়ে কষ্টও পেয়েছেন,যারা নানাভাবে বিপ্লবী মাওবাদী আন্দোলনে রাষ্ট্রের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন।বিপ্লবী আন্দোলনে এই ধরনের ঘটনা যদিও নতুন নয়, আত্মসমর্পনের নাটক বহু পুরোনো কৌশল! তবুও ঘটনা যেহেতু ঘটেছে সাম্প্রতিক সেহেতু এর কোন বিশেষ দিক আছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা দরকার।

আত্মসমর্পণের দিনেই দিবাগত রাত বারোটায় বগুড়ার একটি অঞ্চল ভবানীপুর বাজারে পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির সদস্যরা প্রচার অভিযান চালিয়েছে।তারা এই আত্মসমর্পনের নাটকের বিরোধীতা করে বলেছেন,প্রহসনের আত্মসমর্পন প্রত্যাখ্যান করুন।এই দিনেই পুলিশের সাথে গুলির লড়াইয়ে পুলিশের এক এসআই গুরুতর আহতও হয়েছেন।যা দেশের সমস্ত পত্রিকা থেকেই জানা যাচ্ছে।তাহলে আত্মসমর্পণ যে সবাই করে নি এটা বোঝা গেলো।অর্থাৎ একই দিনে এমন পাল্টা আক্রমণ বুঝিয়ে দিচ্ছে যে, প্রকৃত “তথাকথিত চরমপন্থীরা” তাদের লড়াই চালিয়ে যাবারই ঘোষণা দিচ্ছেন।

এদিকে ডয়চে ভেলে বাংলা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে,”চরমপন্থী সাজিয়ে আত্মসমর্পন” শিরোনামে। সেখানে তারা একজনের সাক্ষাতকার সহ প্রমান নিয়ে প্রকাশ করেছে,
যেখানে বলা হচ্ছে,

“চরমপন্থি নন স্বপন

চরমপন্থি নয় এমন লোককেও চরমপন্থি হিসেবে দেখিয়ে আত্মসমর্পণ করানো হয়েছে বলে জানা গেছে৷ এদেরই একজন পাবনার বেড়া উপজেলার আমিনপুর থানার স্বপন মন্ডল (৩০)৷ তিনি একজন ব্যবসায়ী৷ আমিনপুরের ঢালার চর ইউনিয়নের সিদ্দিক মোড় বাজারে তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম ‘স্বপন স্টোর’৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘আমি একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী৷ আমি সার, বীজ ও কীটনাশকের ব্যবসা করি৷ লাইসেন্সও আছে৷ এছাড়া আমি চাল-ডাল ও ভুসির ব্যবসা করি৷ আমি একজন পাইকারি বিক্রেতা৷ বাজারের সবচেয়ে বড় দোকান আমার৷”

তাহলে আত্মসমর্পণ করলেন কেন? এ কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘আমি কোনো চরমপন্থি দলের সদস্য নই৷ তাছাড়া আত্মসমর্পণের বিষয়টি আমার জানা ছিল না৷ আমাকে মাঠে নিয়ে বসানো হয়৷ সেখানে দেখি ওটা আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান৷ তখন আমার আর করার কিছু ছিল না৷”

তিনি আরো বলেন, ‘‘গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের সময় আমাদের বিরুদ্ধ পক্ষ আমার নামে একটা মামলা করে৷ প্রতিবেশী মনসুর আমাকে বলে যে সে মামলাগুলো শেষ করে দেবে এবং আর যাতে ভবিষ্যতে কোনো সমস্যা না হয়, তারও ব্যবস্থা করবে৷ আর সেটা করতেই আমাকে নিয়ে সেদিন পাবনা যায় সে৷”

তিনি জানান, ‘‘অনুষ্ঠানে একটি ব্যাগে করে আমাদের এক লাখ করে টাকা দেয়া হয়৷ আমরা মাঠে বসা ছিলাম৷ তখন কিছু লোক মঞ্চে গিয়ে আত্মসমর্পণ করে৷ ওই টাকা আমি রেখে দিয়েছি, ধরিনি৷ আমাকে কেন ওই টাকা নিতে হবে! আমি তো স্বচ্ছল ব্যবসায়ী৷”

এরপরেই আরেক অংশে,
পাবনার পুলিশ সুপার শেখ রফিকুল ইসলামের কাছে স্বপন মন্ডলের প্রসঙ্গ তুললে তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘চরমপন্থি নয় অথচ আত্মসমর্পণ করানো হয়েছে, এ রকম কিছু অভিযোগ আমরা পেয়েছি৷ অর্থাৎ আত্মসমর্পণে কিছু ত্রুটি আছে৷ আমরা সেগুলো তদন্ত করে দেখছি৷ তেমনটা হলে তাদের তালিকা থেকে বাদ দেয়া হবে৷”

উপরের প্রতিবেদনের তথ্য এবং পুলিশ সুপারের স্বীকারোক্তি প্রমান করে যে এই আত্মসমর্পন ছিলো ভূয়া।এই আত্মসমর্পনে মূলত কিছু অধঃপতিত এবং সাজানো লোককে নিয়ে একটি নাটক মঞ্চস্থ করা হয়েছে।কিন্তু এই সময়ে এসেই এই আত্মসমর্পন নাটক মঞ্চস্থ করার কারণ কি?

এবার আমরা একটু গভীরে যেতে পারি।আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে বিপ্লব এবং জাতীয় লড়াই দমনের লক্ষে শাসকশ্রেনীর পরিচালিত যুদ্ধ হলো মূলত নিচু মাত্রার যুদ্ধ।যে যুদ্ধ প্রচলিত কোন যুদ্ধ নয়।এই যুদ্ধ সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে পরিচালিত করা হয়।কি সেই নিচু মাত্রার যুদ্ধ?
দেশে বিপ্লবী লড়াই ও এর দমনের প্রক্রিয়া নিয়ে নানান গবেষনা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নতুন ভিত্তিতে তাদের যুদ্ধ কৌশল সাজিয়েছে। এরা আর আগের কায়দায় সম্মুখ যুদ্ধে প্রথমেই যেতে চায় না।এতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি তাদের স্বীকার করতে হয়েছে। ভিয়েতনাম যুদ্ধে এরা প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার পরে এবং দেশে দেশে বিপ্লবী আন্দোলনের জোয়ারের সময়ে বিপর্যস্ত হয়ে এরা নতুন করে যুদ্ধ কৌশল সাজিয়েছে।গত শতাব্দীর আশির দশক থেকে সাম্রাজ্যবাদ তার যুদ্ধ কৌশল পরিবর্তন করে নতুন ভিত্তিতে মাঠে নেমেছে।দেশে তার সঙ্গী হয়েছে তাবেদার সরকার সমূহ এবং কখনো কখনো এই তাবেদাররা এই শিক্ষা আয়ত্ব করে নিয়ে নিজেরাই প্রয়োগ করছে।

শক্তি এবং হিংসার তীব্রতা বাদ দিয়ে তারা যুদ্ধকে তিন ভাগে ভাগ করে এই সময়ে।১.উঁচু মাত্রার যুদ্ধ,২.মাঝারী মাত্রার যুদ্ধ,৩.নিচু মাত্রার যুদ্ধ।এখানে উঁচু মাত্রার যুদ্ধ হলো প্রচলিত যুদ্ধ এবং এই যুদ্ধের বিস্তৃতি ব্যাপক বিশাল।পুরো বিশ্ব এতে যুক্ত হয়ে পরে।প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এই যুদ্ধের মধ্যে পরে।আর মাঝারী মাত্রার যুদ্ধ হলো প্রচলিত যুদ্ধ এবং উঁচু মাত্রার যুদ্ধ থেকে বিস্তৃতি এর কম থাকে,কয়েকটি দেশ বা দুই দেশের মধ্যে যে যুদ্ধ তাকে মাঝারী মাত্রার যুদ্ধ বলে।এবং নিচু মাত্রার যুদ্ধ হলো, সাম্রাজ্যবাদ কর্তৃক বিপ্লবী যুদ্ধ,জাতীয় মুক্তি বা বিদ্রোহ দমনের যুদ্ধ।

এই শেষোক্ত যুদ্ধ ১ও২ নং যুদ্ধ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক একটা যুদ্ধ।এই যুদ্ধ সহজে বোঝার উপায় নেই।এই যুদ্ধ এক সর্বাত্মক যুদ্ধ।যে যুদ্ধ তার সমস্ত সক্ষমতা খাটিয়ে বিদ্রোহ দমন করে প্রচলিত পদ্ধতিকে পাশে রেখে।কারণ সাম্রাজ্যবাদী বিশেষজ্ঞদের মত হচ্ছে, বিপ্লবী যুদ্ধের কারণ শুধুমাত্র সামরিক নয়।এটা সামাজিক এবং রাজনৈতিক। তাই তারা শুধু সামরিক দিক দিয়ে আগ্রাসন চালিয়েই ক্ষান্ত হন না।তারা মনস্ততাত্ত্বিক,অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক এবং বল প্রয়োগের মাধ্যমে নিচু মাত্রার যুদ্ধ চালায়।

এক্ষেত্রে আত্মসমর্পণ নাটক মনস্ততাত্ত্বিক লড়াইয়ের সাথে যুক্ত।শাসক দল আত্মসমর্পন নাটক সাজিয়ে বিপ্লবী জনগন এবং বিপ্লব সমর্থকদের মতাদর্শকে দূর্বল করে দিতে চায়। অনেক ক্ষেত্রে তারা সফলও হয়।কারণ যারা তুলনা মূলকভাবে মতাদর্শগতভাবে দূর্বল এবং বিপ্লবী রাজনীতি ভালোভাবে বোঝেন না তারা বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন।এতে করে সমর্থকদের মধ্যে একটা বিভ্রান্তি ছড়াতে চায় রাষ্ট্র ।এভাবে যুদ্ধ করার মনোবলকেও দূর্বল করার চেষ্টা করা হয় এবং এটা প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্য থাকে যে, বিপ্লবী আন্দোলন আর এখানে চলবে না।বিপ্লব বিপর্যস্ত হবার পথে।এই স্থানে আর এসব দিয়ে বিপ্লব হবে না।
এই সময়ে এসে বিপ্লবীদের আত্মসমর্পন এর নাটক দিয়ে এটা প্রমান করতে চাওয়া হচ্ছে যে এখানে বিপ্লবী আন্দোলন পুরোপুরি শেষ হয়ে গেছে।কারণ শাসকশ্রেনী বিপ্লবী রাজনৈতিক উত্থান এর আশঙ্কা করছে। এই চরম ফ্যাসিবাদী সময়ে একমাত্র মাওবাদী বিপ্লবীরাই রাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকী হতে পারে।একদিকে সীমাহীন লুটপাট ও দুর্নীতি এবং জনগনের উপর নিপীড়ন সত্যিই বিপ্লবী রাজনৈতিক উত্থান এর সম্ভাবনাকে এগিয়ে নিচ্ছে।জনগন এখন তার ঘাড় থেকে ভারতের দালাল হাসিনা-আওয়ামীলীগ নামক ফ্যাসিবাদী জোঁয়াল কে নামানোর শক্তি খুঁজছেন।আর বর্তমানে এই রকম শক্তি হয়ে উঠতে পারে একমাত্র মাওবাদীরাই।কারণ গত কয়েক বছর ধরেই মাওবাদীদের প্রচার এবং বিভিন্ন আন্দোলন এর মধ্যে দিয়ে মাওবাদীদের মতাদর্শিক বিকাশ এখানে ঘটেছে।অন্যদিকে,শাসকদের নিজেদের মধ্যেকার বিরোধী অংশ ইতিমধ্যেই ব্যাপকভাবে পর্যুদস্ত হয়েছে। তাদেরকে আর সেভাবে হুমকী মনে করা হচ্ছে না।তাই নতুন করে আত্মসমর্পন এর নাটক সাজানো হয়েছে।যেনো এই প্রচার ব্যাপকভাবে চালানো যায় যে, এদেশে আর বিপ্লবী নেই।আত্মসমর্পন অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হুশিয়ার দিয়ে বলেছিলেন যারা আত্মসমর্পন করছে না তাদের জন্য দেশের বাহিনী রয়েছে। এবং তারপর থেকেই বিপ্লবী হত্যার উৎসব শুরু হয়েছে।আত্মসমর্পন নাটকের পরেই বেশ কয়েক জন বিপ্লবী জনগন কে হত্যা করা হয়েছে ক্রসফায়ারের নামে,যা চলমান রয়েছে।প্রথমে আত্মসমর্পন এর নাটক এবং তার পরেই এভাবে ক্রসফায়ার অভিযান এটাই নির্দেশ করছে যে, রাষ্ট্র আবারো মাওবাদী উত্থান এর ভূত দেখছে।যা তাকে প্রতিনিয়ত তাড়া করে বেড়াচ্ছে।এই ভূত নিশ্চয় তার সকল শক্তি নিয়ে রাষ্ট্রকে এক তীব্র আঘাতে চুরমার করে দেবার প্রস্তুতি কে এগিয়ে নেবে।